মঞ্চের চার কোণে চারটে হ্যাজাক জ্বলছে। হা হা অট্টহাসিতে মঞ্চে প্রবেশ রাবণের। সেই হাসির গমকে হ্যাজাক ঘিরে থাকা শ্যামা পোকাগুলোও যেন ভয় পেয়ে কিছুটা সরে গেল। ছেলে-ছোকরাদের তো পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়!
ভগবানগোলার অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার মহিমাপ্রসাদ তালুকদারের স্মৃতিপটে আজও সেই দৃশ্য অমলিন। খেদের সঙ্গে বললেন, ‘‘শান্তিগাপালের লেনিন, সেই নেতাজি, সেই রাম-রাবণের পালা আজ আর কোথায়! তার বদলে এখন কান ঝালাপালা করা ডিজের আওয়াজে চিল চিৎকারের অমুক নাইট, তমুক নাইট। কোথাকার সংস্কৃতি কোথায় এসে যে পড়েছে!’’
একদা বহরমপুর শহরের যাত্রানুরাগী মানুষের জন্য বাল্যবিধবা রানি স্বর্ণময়ী কলকাতা থেকে বিখ্যাত যাত্রার দল নিয়ে এসে আসর মাত করেছেন। বিদগ্ধ যাত্রাপালা ছাড়াও এই শহরে কাশিমবাজার রাজবাড়ির বদান্যতায় খোদ কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগানে মুগ্ধ হয়েছে সংস্কৃতির শহর বহরমপুর। বিশিষ্ট কবিয়াল দুলালি চিত্রকর বলেন, ‘‘মানুষের রুচি পাল্টেছে। তাই সঙ্গীত উপলব্ধির কানও পাল্টেছে। তার উপরে নোট-কাণ্ডের হ্যাপায় এ বার কবিগানের আসর কমেছে। এখন আম-পাবলিকের অনুষ্ঠানের বদলে সরকারি অনুষ্ঠানের মুখাপেক্ষি থাকতে হচ্ছে আমাদের।’’
নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ পৌষমাস ভর মেতে থাকত হোলুই গানে। জলঙ্গির তীর ঘেঁষা স্বরূপগঞ্জ, আমঘাটা গ্রামে বসতো পুতুলনাচের আসর। স্থানীয় বাসিন্দা কল্লোল কর বললেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের মধ্যে একটু অন্য রকম ছিল শীতকালটাই। দিনের বেলায় বাড়ি থেকে চালডাল এনে জমির নতুন আলু দিয়ে কারণে অকারণে গ্রাম্য চড়ুইভাতি। আর রাতে পুতুলনাচ কিংবা যাত্রা। তবে সব যাত্রা দেখার সুযোগ ছোটদের ছিল না।’’ স্বরূপগঞ্জে মাঠে এখন আর যাত্রার আসর বসে না। পুতুলনাচ তো ইতিহাস। তবে শীতের স্বরূপগঞ্জ এখনও উৎসবে মাতে। পপকর্ন, চাউমিন সুবাসিত বইমেলায় সেলফি তোলার হুড়োহুড়ি পড়ে যায় গ্রামের নতুন প্রজন্মের মধ্যে।
মফফসল শহরের শীতের অনিবার্য বিনোদন ছিল পরপর তিন চার-রাত যাত্রার আসর। স্বপনকুমার, তপনকুমার, বীণা দাশগুপ্তরা দাপিয়ে বেড়াতেন তিন দিক খোলা মঞ্চে। তেমন নামকরা পালা হলে যাত্রার মাঝ পথে খুলে দিতে হতো প্যান্ডেলের টিন। যাঁরা টিকিট কাটতে পারেননি, তাঁদের জন্য উদ্যোক্তাদের সৌজন্য। সেই রথের দিন চিৎপুরে গিয়ে বায়না করে আসাতক যত দিন না যাত্রা মিটছে, গোটা এলাকায় নানা জল্পনা হতো আসন্ন পালা নিয়ে। জ্বলজ্বলে চোখে সে সব গল্প বলছিলেন নবদ্বীপের অন্যতম যাত্রা আয়োজক নিত্যানন্দ আচার্য।
এক সময় কলকাতার নামী শিল্পীদের নিয়ে শীতকালে ম্যারাপ বেঁধে গানের জলসা বাঁধা থাকত কোনও কোনও শহরে। শ্যামল মিত্র, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়— কে থাকতেন না? সন্ধ্যায় শুরু হয়ে বেশি রাতে শেষ হওয়া সেই সব মাঠ জলসার নানা গপ্প শহরের আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ায় আজও। বহরমপুরেই যেমন, এক সময় পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, বড়ে গোলাম আলি খাঁ, পণ্ডিত শ্যামল বসু, আলি আকবর খাঁ প্রমুখের গান ও বাজনায় শীতের সারাটা রাত কেটে গিয়েছে কল্পনা হাউস, সূর্য সিনেমা হল, বিমল সিংহ কালচারাল হল, রবীন্দ্রসদনের আসর। অনেক সময় হলের অভাবে সিনেমা শেষের পর রাত ১০টা থেকে প্রেক্ষাগৃহে শুরু হতো খেয়াল, ঠুংরি, সেতার, সারেঙ্গি, সানাই, তবলার যুগলবন্দি। চলত ভোর পর্যন্ত। সে সবই এখন ইতিহাস।
সেই মাপের শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে তেমন জলসাও। তার জায়গা নিয়েছে ‘নাইট’। সেখানে ভিড় করছেন সিরিয়ালের চেনা মুখের দল। নাচগানের এক জগঝম্প অনুষ্ঠান এখন জলসার বদলে শীতের রাতে চেনা বিনোদনে পরিণত হয়েছে। মঞ্চ মাতাচ্ছে টেলি-সিরিয়ালের ‘গানওয়ালারা’।
‘‘তবে শীতকালে আমাদের ছোট শহরে কোনও দিনই সার্কাস আসত না। সার্কাস দেখতাম বারোদোলের মেলায়,’’ বলছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা সুনীলকুমার বসু। তবে বাড়িতে বাজারে শীতকালের একটা ছাপ চোখে পড়ত। আশি ছুঁই ছুঁই সুনীলবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের অভাবের ছোটবেলায় ফুলকপির শিঙাড়া কিংবা বাড়িতে নলেন গুড়ের পায়েস মানেই ছিল উৎসব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy