মানিয়েছে বেশ: ডোমকলে। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
ও ফুলবানো.... এট্টু পানি দে দেহি।
ঘরের দাওয়ায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে আকাশপাতাল ভেবেই চলেছে বছর দশের মেয়েটা। বাবার ডাক তার কানে পৌঁছয় না।
ইদ এসে গেল। উঠোনের নিম ছায়ায় খাটিয়া পেতে শুয়ে মোতি মিঞা। সক্কাল সক্কাল এক পাত্তর দিশি মদ চড়িয়ে এসেছে সে। নেশার পর রোদ-ছায়ার তেমন হুঁশ নেই তার।
নিজে উঠে একটু জল গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে না তার। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও ভেতর থেকে সাড়াশব্দ না আসায় মেজাজটা খিঁচড়ে গেল তার। ঘরে ঢুকে মেয়েকে ঝাঁঝিয়ে উঠল— ‘কীরে শুনতে পাস না, কখন থেকে এট্টু পানি দিতে বলছি।’’
বাবার চিৎকারে সম্বিত ফেরে মেয়ের। মোতি কাছে এলে একটা তীব্র কটুগন্ধে গা-টা ঘুলিয়ে উঠল বানুর। ‘কী ভাবিস সারাক্ষণ’! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ফের ঝাঁজিয়েওঠে মোতি। জবাব দেয় না বানু। তার শীর্ণ হাত জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় মোতির দিকে। আড়চোখে উনুনের দিকে একবার তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। মাটির উনুনের আগুন কখন নিভে গিয়েছে, খেয়ালও করেনি। উনুনে বসানো ভাতের হাঁড়ির সরাটাও সরাতে ভুলে গিয়েছে। ঢাকনা উথলে ফ্যান গড়িয়ে পড়ছিল হাঁড়ির গা বেয়ে। ঢাকনা খুলে খানিকটা জল ঢেলে দেয় বানু। তারপর বাবা চলে যেতেই ফের হাঁটুতে মুখ গুঁজে চিন্তায় ডুবে গেল।
শৈশবের কত কথাই যে এই সময় মনে পড়ে যায় তার। ঘুরেফিরে ভেসে ওঠে মায়ের মুখটা। আগের দিন মেলার মাঠে সমবয়সী একটা মেয়েকে দেখেছিল বানু। ফুলআঁকা ফ্রক পরে মায়ের সঙ্গে কাচের চুড়ি কিনছিল। তার সরু হাতে রঙিন চুড়িগুলো একে একে পরিয়ে দিচ্ছিল মা। ওই মহিলাকে দেখে রেশমা বিবির জন্য মনটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল তার। গত বছর পাড়ার মেলায় মা’র সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল বানু। একটা কাচের চুড়ির দোকানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মেয়েকে সেখান থেকে নড়াতে পারছিল না রেশমা। মেয়ের বায়না— একগাছা রঙিন চুড়ি তাকে কিনে দিতেই হবে। বারবার মেয়ের মন ঘোরানোর চেষ্টা করেও পারেনি রেশমা। মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে হয় তাকে। আঁচলে বাঁধা পাঁচ টাকায় মেয়েকে একগাছা চুড়ি কিনে দেয় সে। কচি হাতে দু’গাছা চুড়ি রেশমা যখন পরিয়ে দিচ্ছিল, খুশিতে উথলে উথলে উঠছিল ফুলবানু।
এর চার-পাঁচদিন পরের কথাই তো হবে! প্রতি দিনের মতো রাতে মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরল মোতি। রেশমা প্রতিবাদ করায় শুরু হল মার। স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে দাওয়ায় ফেলে তাকে পরের পর লাথি মারছিল মোতি। মার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছিল বানুর। এক সময় কাঁদতে কাঁদতে রেশমার কোলের উপর আছড়ে পড়ে সে। তার পর থামে মোতি। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে বানু দেখে, ঘরের বাতা থেকে ঝুলছে রেশমার নিথর শরীরটা।
একটা সময় ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ে থাকত মোতির বাপ-কাকারা। বছর পঞ্চাশ আগে বেলডাঙায় চলে আসে তারা। বছরের বাকি সময় মোতি মুনিস খাটে। আর বাকি সময়টা সময়টা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাদারির খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। আগে একাই যেত। রেশমা মারা যাওয়ার পর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যায়। গত কয়েক দিন কুমারপুরের মেলায় মাদারির খেলা দেখাচ্ছে বাবা-মেয়ে। প্রথম প্রথম দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় ভয়-ই করত বানুর। এখন করে না।
কচি হাতে একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে দড়ির ওপর দিয়ে তরতর করে হেঁটে চলে যায় সে। হাততালিতে ফেটে পড়ে। বেশ লাগে ফুলবানুর। তবে আজ সে সব থেকে ছুটি। মোতির শরীরটা ভাল নেই। দুপুর থেকে বড্ড রোদ্দুর। বৃষ্টি নামতে পারে। আজ তাই আর খেলা দেখাতে যাবে না সে। বিকেলে কুমারপুরে গেল বানু। মেলার মাঠে ঘুরতে ঘুরতে সেই কাচের চুড়ির দোকানের সামনে পা-টা আটকে গেল তার। জুলজুল করে রঙিন চুড়িগুলো দেখছিল সে। তাকে দেখে দোকানের মহিলা বলে উঠলেন, ‘কী গা মাইয়া, চুড়ি নেবে নাকি’’। মাথা নাড়ল বানু। কিনবে কী করে! তার কাছে তো পয়সা নেই। মাথা নাড়ে সে, ‘এমনি দেখত্যাসি।’
বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ফের চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মা’র মুখটা মনে পড়ছিল তার। গতবার এমনই এক মেলায় রেশমা....। তাকে একা ফেলে এ ভাবে চলে যাওয়ার জন্য মার উপর রাগই হচ্ছিল বানুর।
হঠাৎ একটা হাল্কা ছোঁয়ায় সম্বিৎ ফিরল। বানু দেখল, সস্তার চুড়ি পরা একটা হাত তার কচি হাতে দু’গাছা কাচের চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। সে বিস্ময়মাখা চোখে তাকাতে দোকানের সেই মহিলা বলে উঠল, ‘‘তুমায় পয়সা দিতি হবিনি। এডা আমি তোমায় এমনি দিলেম গো।’’
মার মুখটা আবার মনে পড়ে গেল বানুর। বৃষ্টি নয়। মাদারির মেয়ের দু’গাল বেয়ে নোনতা জলের ধারা নামে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy