ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর হরিদাস রায়ের মতো শিল্পীরা। তাই সাজিয়ে তুলছেন পুতুল। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
এখনও মাঝে মধ্যে আঙুলগুলো আপনা থেকেই নড়ে ওঠে বিশ্বনাথ বড়ালের। সেই ছোট্ট বেলায় বাবার হাত ধরে পুতুলনাচের তালিম নিয়েছিলেন। তারপর গ্রামবাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বছরের পর বছর। এখন আর পুতুল নাচে মানুষের মন ভরে না। পুতুলনাচে দেখতে কেউ আসে না। বাধ্য হয়ে পতুলের দড়ি ছেড়ে এখন কাস্তে হাতে তুলে নিয়েছেন। পুতুল-হারমোনিয়াম ছেড়ে তিনি আজ দিনমজুর।
এই অবস্থা যে শুধু বিশ্বনাথবাবুর একার তা নয়। হাঁসখালির মুড়াগাছা কলোনির চিত্রটাই কমবেশি একই। কয়েক বছর আগেও যে গ্রামে শতাধিক দল ছিল। এখন সেটা কমতে কমতে চারটেতে নেমে এসেছে। তাই এক সময় বাংলার বাইরেও বিহার, অসমে দাপিয়ে বেড়ানো শিল্পীদের কেউ আজ দিনমজুর। কেউ কাঠের মিস্ত্রি। কেউ বা রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভিন্রাজ্যে।
অথচ এক সময় মুড়াগাছা কলোনিকে পুতুল নাচিয়ে গ্রাম হিসেবে একডাকে চিনত গোটা বাংলা। কৃষ্ণনগর-বগুলা রাজ্য সড়ক থেকে মুড়াগাছা বাজার থেকে ডান দিকে চলে যাওয়া পিচের রাস্তাটা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে পড়ে পুতুল নাচের এই গ্রাম। শিল্পীদের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, রাজা হরিশচন্দ্র, সাবিত্রী-সত্যবান, শ্রীকৃষ্ণের গুরুদক্ষিণা বা রামায়ণের মতো ‘হিট শো’ মাতিয়ে রাখত গ্রামবাংলাকে। কোথাও তাঁদের তাঁবু পড়লে, পুতুল নাচের আসর বসলে গাঁ-গঞ্জ উজিয়ে লোকে আসত তাঁদের শো দেখতে। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘এমন সময় ছিল তাঁবু ফেললে আশেপাশের ভিডিও হলগুলো ফাঁকা হয়ে যেত। হলের মালিকরা খোঁজ নিতেন কবে আমরা উঠে যাচ্ছি।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘দিনে দিনে অবস্থা এমন হল যে বাধ্য হলাম সব জলের দরে বিক্রি করে দিতে। কিন্তু তাই বা কিনবে কে? সকলেরই তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। তাই জলের দরে বাপদাদার জমি বিক্রি করে দেনা মিটিয়েছিলাম।’’ গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ হরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘‘দলে আমি মাস্টার ছিলাম। পালায় আমার গান শুনতে বারবার আসত মানুষ।’’
বাংলাদেশে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এদেশে এসে কোনও রকমে যখন থিতু হলেন, তখন নিজেদের পুরনো পেশাটা ফের আঁকড়ে ধরেছিলেন জিতেন হালদার, বিমল বিশ্বাস, জগদীশ সিকদাররা। গড়লেন ভারতমাতা, ভারতলক্ষী, জগৎলক্ষীর মতো পুতুল নাচের দল। তাঁদেরই হাত ধরে পুতুল শিল্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মুড়াগাছা কলোনির ঘরে ঘরে। ক্রমে গ্রামের ‘স্টিং পাপেট’ বা ‘দড়ির পুতুলের’ নাচের জনপ্রিয়তা পৌঁছে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে। আশ্বিন মাসে বেরিয়ে পড়তেন গ্রামের পুরুষরা। কখনও কখনও বা সঙ্গ নিতেন মহিলারাও। সারা বাংলায় তাঁবু ফেলে নাচ দেখিয়ে ফিরে আসতেন বৈশাখে।
এখনও যে ক’টি দল টিকে রয়েছে, সরকারি দাক্ষিণ্যে তারা কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সবার শৌচাগার, বাল্য বিবাহ বা পণপ্রথার বিরুদ্ধে নাচ দেখাতে হাজির হয় বিভিন্ন সচেতনমূলক অনুষ্ঠানে। তার জন্যে শো পিছু শিল্পী প্রতি মেলে হাজার টাকা। লোকশিল্পীর ভাতাও পান কেউ কেউ। তাই নিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদেরই এক জন মন্মথ বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখন কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর পালা করি। সরকার টাকা না দি লে কবেই সব শেষ হয়ে যেত।’’
পুতুল শিল্পীরা জানালেন, ঘুরে দাঁড়াতে শেষবারের জন্য একটা চেষ্টা হয়েছিল। পৌরাণিক, সামাজিক পালাগুলো নতুন ঢঙে লিখে, পালার ভাষার কিছুটা ‘চকট’ মানুষের মন ভে়জানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। এখন বাড়ি আনাচেকানাচে অনাদরে পড়ে সোলার তৈরি পুতুল। বেশির ভাগই রঙ উঠে, রোদেজলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে এতো সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন শিল্পী হরিদাস রায়। এখনও তিনি গ্রামে-গ্রামে, মেলায়-মেলায় তাঁবু ফেলেন। ১৯ পয়সা থেকে টিকিট করেছেন ১০ টাকা। তাতে কোথাও কোথাও দর্শক হয় আবার কোথাও একেবারেই হয় না। উত্তরবঙ্গের চা বাগানে আদিবাসী ও মদেশিয়া সমাজে এখনও পুতুল নাচের চাহিদা আছে। ওটাই যা ভরসা। হরিদাসবাবু বলেন,‘‘বছর পাঁচেক আগেও কিন্তু এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। টিভি আসার পর আমাদের দুর্দিন শুরু হয়েছে।’’ বাড়িতে টিভি আছে। তবুও তা দেখেন না তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী রায়। প্রসঙ্গটা তুলতেই ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেন, ‘‘দেখব কী? টিভিই তো গিলে খেল গোটা গ্রামটাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy