কথা ছিল, আর কেউ না নিক, রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার বা সরকারি বাস পাঁচশো-হাজারের নোট নেবে। নিয়েছে।
কথা ছিল, পেট্রোল পাম্পে তেল ভরিয়ে ‘বাতিল’ নোট দিলে তারাও নিয়ে নেবে। নিয়েছে।
কথা ছিল, হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান ফেরাবে না রোগীদের, তামাদি হয়ে যাওয়া নোট নেবে। তারাও নিয়েছে।
কিন্তু ভাঙাতে রাজি হয়নি কেউ। বুধবার সকালের দিকে যা-ও বা একটু-আধটু ভাঙানি মিলেছে, বেলা বাড়তেই ‘নেই-নেই’। হয় একশোর নোট দাও, নয় বাড়ি যাও! একটাই কথা— ‘এত ভাঙানি পাব কোথায়? সবাই তো বড় নোট নিয়ে আসছে!’ মুখচেনা দেখে কিছু পাম্প বা ওষুধের দোকান পাঁচশোর নোট জমা নিয়েছে, বাকিটা পরে ফেরত দেওয়া হবে জানিয়ে। ইলেকট্রিক ও টেলিফোন বিল জমা দিতে না পেরে অনেকেই রাগে ফেটে পড়েছেন।
পেটের এক্সরে করাতে রানিতলার নশিপুর গ্রামীণ হাসাপাতাল থেকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালে এসেছিলেন মুজিবর রহমান। হাসপাতাল চত্বরে পিপিপি মডেলের পরীক্ষাগারে পৌঁছে তাঁর চোখ কপালে। দেওয়ালে লেখা নোটিস বলছে, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট নেওয়া হবে না। অনেক অনুরোধ-উপরোধেও তাদের রাজি করাতে না পেরে লালদিঘি পাড়ের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তিন গুণ টাকা দিয়ে এক্সরে করান তিনি। কিন্তু বহরমপুর আসার পথেই ট্রেকার, ট্রেন ও টুকটুক ভাড়া দিতে ভাঙানি শেষ। পাইস হোটেলে ঢুকে কিছু খাবেন, তারাও বড় নোট নেবে না! স্টেশনে এলেন, ফেরার টিকিট কাটবেন। কাউন্টারের বাবু বললেন, ‘পাশে সরে দাঁড়ান! ভাঙানি হলে ডাকব।’
ধুলিয়ান বিদ্যুৎ দফতরে নোটিস দিয়ে পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। বিলের টাকা জমা নেওয়ার কাউন্টারও বন্ধ রাখা হয় এ দিন। ফলে ঘুরে যান কয়েকশো গ্রাহক। বিক্ষোভ হয়। বহরমপুর টেলিফোন দফতরও বড় নোট নেয়নি।
রঘুনাথগঞ্জে পেট্রোল পাম্পের মালিক পলাশ ধর বলেন, “৫০০ বা ১০০০ টাকা নোট নিয়ে ডিজেল বা পেট্রল দেওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু ফেরত দেওয়ার মত খুচরো টাকা নেই তাই পুরো টাকারই তেল নিতে হয়েছে গ্রাহকদের।”
বড় সমস্যা দাঁড়াচ্ছে অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে। যেমন বিড়ি শ্রমিকদের সপ্তাহে মজুরি মেটানো হয় প্রতি শনিবার। অরঙ্গাবাদ বিড়ি মালিক সমিতির সম্পাদক রাজকুমার জৈন বলেন, “প্রতি শনিবার কয়েক কোটি টাকা লাগে। ব্যাঙ্কগুলি যদি চাহিদা মতো নতুন বড় নোট ও খুচরো ১০০ টাকার নোট পর্যাপ্ত দিতে পারে, তবেই মজুরি হাতে পাবেন শ্রমিকেরা। ভরসা কম।”
মঙ্গলবার রাতে টাকা বাতিলের খবরটা বোমার মতো ফেটে পড়তেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি শুরু হয়েছিল এটিএমের সামনে। সেখানেই বা কত মজুত ছিল? তা ছাড়া, ৪০০ টাকার বোতাম টিপে-টিপে কতই বা তোলা যায়? (৫০০ টিপলেই যদি হুশ করে সবুজ নোট বেরিয়ে আসে!) বিশেষ করে পিছনে যখন লম্বা লাইন! কিছু লোক হয়তো কিছু টাকা পেয়েছেন, বাকিরা ফক্কা। সকালে কারও-কারও হাতে সম্বল বড় জোর তিন-চারটে একশোর নোট। বাকি সব কড়কড়ে অচলপত্র!
কিন্তু অনেকটা সামাল দিয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরাই। অনেকেই পাঁচশো বা হাজার টাকা নিয়েছেন এ দিনও। ধার দিয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার নেনওনি। বহরমপুরের স্বর্ণময়ী বাজারে তাপস হাজরার মোবাইলের রিচার্জের দোকান। তিনি বলেন, ‘‘অন্য দিনের থেকে আজ ৫০০ টাকার নোট বেশি দিয়েছেন গ্রাহকরা। সবাইকে রিচার্জ করে দিতে পারিনি। অত একশোর নোট পাব কোথায়?’’ লালগোলার মল্লিকপুরের সারজেমান শেখ ৩০০ টাকার ওষুধ কেনেন। তিনি বলেন, ‘‘দোকানদার আমাকে ধারে ওষুধ দিয়ে বলেন, অন্য দিন টাকা নেবেন।’’ লালগোলায় মুদির দোকান থেকে যাবতীয় কেনাবেচাও ধারে হয়েছে।
নোট বাতিলের ধাক্কা লেগেছে সব্জি থেকে শুরু করে মাছ ও মাংসের বাজারে। বহরমপুরের স্বর্ণময়ী বাজারের সব্জি ব্যবসায়ী দীনশ মণ্ডল, মাছ ব্যবসায়ী সেন্টু হালদার, মাংস বিক্রেতা সাত্তার শেখ ও ফল বিক্রেতা সুবোধ দাস বলেন, ‘‘মহাজনরা আমাদের কাছ থেকে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নিচ্ছে না। তাই আমরাও খদ্দেরের কাছ থেকে নিচ্ছি না। তার ফলে এ দিনের বেচাকেনা গত দিনের বেচাকেনার অর্ধেকে নেমে গিয়েছে।’’ এক মাত্র খুশি ধুলিয়ানের দোকানি ও ব্যবসায়ীরা। কেননা সেখানে জাল নোটের ঝামেলায় সকলে জেরবার। পুরপ্রধান সুবল সাহা বলেন, ‘‘জাল নোটের রমরমায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম আমরা, তাতে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা খুশি।”
তবে অন্য বিপদ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
ইতিমধ্যেই নানা আনাচে-কানাচে পাঁচশোর নোট নিয়ে তিনটে বা চারটে একশোর নোট দেওয়ার খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলো দ্রুত টাকার জোগান না দিলে ব্যাপক ফড়েরাজই না কায়েম হয়ে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy