সুজিত সরকারের ছবিতে ‘অর্জুন সেন’-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন। ছবি: সংগৃহীত।
সিনেমা শুরুর মিনিট পনেরো পর থেকেই পাশের সিটে ফিসফাস, ‘‘হাঁটাটা দেখ, একেবারে বাবার মতো’’, ‘‘পিছন থেকে কিন্তু অমিতাভ অমিতাভই লাগে।’’ ছবি যত এগিয়েছে এই ফিসফাস বেড়েছে। অভিষেক বচ্চন যবে থেকে পর্দায় এসেছেন তবে থেকেই এই ধরনের মন্তব্যগুলি তাঁকে তাড়া করেছে। দর্শক ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পর্দায় তাঁর উপস্থিতিকে চিরকালই তাঁর প্রবাদপ্রতিম বাবার সঙ্গে তুলনা করতে করতে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়েছেন এবং ‘ঠিক জমল না’ বা ‘বাবার ধারেকাছে নয়’ বলতে বলতে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। একজন শিল্পীর অভিনয়জীবনে এ এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। নাম, কাজের ধরন, ভোটার বা আধার কার্ড, এমনকি পাসপোর্ট আলাদা হলেও, পর্দায় তিনি শুধুমাত্র অমিতাভ বচ্চনের ছেলে। সুজিত সরকার পরিচালিত ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ ছবিতে অভিষেক যেন খুব যত্ন করেই বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে অন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁর অভিনীত ‘গুরু’ বা ‘যুবা’র মতো ছবিকে মাথায় রেখেও অক্লেশেই বলা যায় ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ ছবিটি অভিষেক বচ্চনের অভিনয় জীবনের মাইলফলক হয়ে থাকবে।
সুজিত সরকার তাঁর খুব কাছের বন্ধু অর্জুন সেনের জীবনী নিয়ে এই ছবি তৈরি করেছেন। যেখানে অর্জুন সেন (অভিষেক বচ্চন) একজন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়া তো বটেই, বিশ্ব বিপণন জগতে অর্জুন বেশ পরিচিত একটি নাম। তার অফিসে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং চলাকালীন অর্জুন অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় তার গলায় ক্যানসার হয়েছে। স্ত্রীর সঙ্গে অনেক দিন আগেই বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া অর্জুনের কাছের মানুষ বলতে তার মেয়ে রেয়া (আহিল্যা বামরো)। বিখ্যাত ডাক্তার জয়ন্ত দেবের (জয়ন্ত কৃপালনি) কাছে গিয়ে অর্জুন জানতে পারে তার আয়ু আর মাত্র একশো দিন। অর্জুন চমকে ওঠে, কিন্তু ভেঙে পড়ে না। এর পর তার শরীরে পরপর কুড়িটা অস্ত্রোপচার হতে থাকে। অর্জুন তার মেয়েকে আঁকড়ে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। অর্জুন কি সুস্থ হয়ে উঠবে? মিটিং, ‘কনফারেন্সে’ বা নিজের জীবনে আবার কথা বলতে পারবে? এই সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে যেতেই হবে।
সুজিত সরকার এই ছবিটিকে যেন কাব্যের মতো করে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে কথার থেকে অনুভূতির ভার বেশি। ছবিতে বিভিন্ন সময় অভিনেতাদের গভীর অভিব্যক্তি অসাধারণ আবেগঘন নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে, যেখান থেকে দর্শকের বেরিয়ে আসা কঠিন। ছবির শুরু থেকে, একের পর এক দৃশ্যপট তৈরি হতে থাকে, যেখানে শুধুমাত্র নিস্তব্ধতাই নাটক, তাই এই ছবিতে সংলাপের পরিমাণ কম কিন্তু সংলাপের ধার কম নয়। ছবিতে বেশ কিছু দৃশ্য, যেমন ক্যানসার ধরা পড়ার পর চিকিৎসক ও অর্জুনের প্রথম দেখা, রাতে বাড়ির সিঁড়িতে অর্জুন ও রেয়ার কথোপকথন, ম্যারাথনে দৌড়নোর দৃশ্য, সার্জারির পর হাসপাতালে অর্জুন ও তাঁর মেয়ের অভিব্যক্তি বা ম্যারাথনে বিধ্বস্ত অর্জুনকে পিছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে রেয়ার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অনেক দৃশ্য দর্শক অবশ্যই মনে রাখবেন। সুজিত সরকারের অন্য ছবির মতোই এই ছবিতেও অভিনেতারা ছক ভেঙে চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। জয়ন্ত কৃপালনি এবং আহিল্যা বামরোর সাবলীল অভিনয় এই ছবিতে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করে যেটি আগামী অভিনেতাদের কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। অন্য অভিনেতারাও ছবিতে নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবু ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ ছবিটি একেবারেই যেন অভিষেক বচ্চনের ছবি। ছবির প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি যেন একান্ত নিজের করে ফেলেছেন।
ছবিতে আবহসঙ্গীতের ব্যবহার বেশ সুন্দর ও পরিমিত। যেখানে অনুভব এবং অভিব্যক্তি নাটক তৈরি করে, সেখানে আবহসঙ্গীতকে নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্তটাই কুশলী সঙ্গীত পরিচালকের কাজ। এখানে তিনি সেটাই করেছেন। ছবির চিত্রগ্রহণেও সেই নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। একটি ছবিতে এত কিছু মনে রাখার মতো বিষয় থাকলেও ছবিটি কি দর্শকদের মনে রয়ে যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে প্রথমেই গল্প ও চিত্রনাট্যের কথা উঠবে। ছবিটি বেশ ধীর লয়ে শুরু হয়। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার ওঠাপড়াকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিচালক বোধ হয় গল্প বলার চলনের দিকে নজর কম দিয়ে ফেলেন। ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয় না। শুরুতে দর্শকের সামনে গল্প অনুযায়ী চরিত্রদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজটাও খুব অস্পষ্ট ভাবেই হয়। গল্প ও চিত্রনাট্যের মধ্যে ভারসাম্যের অভাবও স্পষ্ট। বেশ কিছু দৃশ্য অতিরিক্ত অভিব্যক্তি নির্ভর হওয়া এবং বেশ কিছু দৃশ্য অকারণে দীর্ঘ হওয়ার জন্য ছবিটির স্বাভাবিক চলন মার খায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই ছবিটি বেশ ধীর গতিসম্পন্ন হয়ে যায়, ফলে দর্শক একটু উসখুস করতেই পারেন। এমনই বেশ কিছু বিষয় ছবিটিকে ক্রমশ দুর্বল করে তোলে। নিজের বন্ধুর জীবনকাহিনি বলতে গিয়ে পরিচালক হয়তো এই ছবিতে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, তাই এই ধরনের ছোটখাটো বিষয়গুলি তাঁর মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
এমন কিছু আলোচনা, সমালোচনা যে কোনও ছবিতেই থাকতে পারে। কিন্তু সুজিত সরকারের ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ ছবিটি নানা ভালমন্দ নিয়ে শুধুমাত্র অভিষেক বচ্চনের ছবি হয়েই টিকে থাকবে— এটি নিশ্চিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy