Advertisement
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সংসারের আগুন, মৃত ৩ মহিলা

আত্মঘাতী হওয়ার জন্য ঘরের ভিতরে গায়ে আগুন দিয়েছিল বাড়ির ছোট বউ। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মর্মান্তিক ভাবে পুড়ে গে‌ল ওই পরিবারেরই আরও পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে ছোট বউ রাখি ঘোষ (২৪), তাঁর মা মুক্তি ঘোষ (৫৬) ও বাড়ি বড় বউ রানু ঘোষের (৩৫) মৃত্যু হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০৭:১০
Share: Save:

আত্মঘাতী হওয়ার জন্য ঘরের ভিতরে গায়ে আগুন দিয়েছিল বাড়ির ছোট বউ। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মর্মান্তিক ভাবে পুড়ে গে‌ল ওই পরিবারেরই আরও পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে ছোট বউ রাখি ঘোষ (২৪), তাঁর মা মুক্তি ঘোষ (৫৬) ও বাড়ি বড় বউ রানু ঘোষের (৩৫) মৃত্যু হয়েছে। বাকি তিন জন আশঙ্কাজনক আবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মঙ্গলবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে কৃষ্ণনগরের কোতোয়ালি থানার দিগনগর-উত্তরপাড়া এলাকায়।

চোখের সামনে গোটা পরিবারটাকেই জ্বলতে দেখেছেন বৃদ্ধ কা‌নাই ঘোষ। দেখেছেন কী ভাবে ঘরের ভিতর থেকে আদরের নাতনি আর ছেলে, বউমারা উঠোনের উপরে জ্বলন্ত অবস্থায় আছড়ে পড়েছে। চোখ বুজালেই তাই সেই দৃশ্য ফিরে ফিরে আসছে বাববার। বলছেন, ‘‘ছোট বউমা কদিন ধরেই রাগারাগি করছিল। এদিন সন্ধেতেও গন্ডগোল করছিল। কিন্তু নিজের গায়ে যে আগুন লাগিয়ে দেবে ভাবতেও পারিনি।’’ তাঁর কথা অনুযায়ী রাত তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। আচমকা ঘরের ভিতরে আগুন দেখে ছুটে যান কানাইবাবুর ছোট ছেলে নন্দ ঘোষ। ছুটে আসেন তার শাশুড়ি মুক্তি ঘোষও। বিপদ বুঝতে পেরে দু’জনে মিলে মুহূর্তের মধ্যে দরজা ভেঙে ফেলেন। ঘরের ভিতরে তখন জ্বলছেন নন্দবাবুর স্ত্রী রাখিদেবী। তাঁর গায়ের আগুন নেভাতে এগিয়ে যান দু’জন। মুহূর্তে আগুন লেগে যায় তাঁদের গায়েও। চিৎকার শুনে ছুটে আসেন কানাইবাবুর বড় ছেলে সুকুমার ও তার স্ত্রী রানুদেবী। তিন জনকে ঘরের ভিতরে জ্বলতে দেখে ছুটে যান তাঁরাও। ছুটে আগুন নেভানোর জন্য ঘরের ভিতরে ঢুকতেই বাঁচার জন্য তিন জনই তাঁদের জড়িয়ে ধরে। ছুটে আসে কানাইবাবুর মেয়ের মেয়ে শুক্লা ঘোষ। আগুন ধরে যায় তাঁর গায়েও।

এরই মধ্যে জ্বলন্ত আবস্থায় নন্দ ও সুকুমার সকলকে ঘরের ভিতর থেকে উঠোনে আছড়ে ফেলে। নিজেরাও মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে আগুন নেভান। এই দৃশ্য দেখে প্রতিবেশীদের ডাকতে চলে যান কানাইবাবুর স্ত্রী নিবেদিতা ঘোষ। চিৎকার, আগুন আর ধোঁয়া দেখে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। তাঁরাই জল দিয়ে পুরোপুরি আগুন নিভিয়ে সকলকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে প্রথমেই কানাইবাবুর নাতনি শুক্লাকে কলকাতার নীলকতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করানো হয়। তাঁকে অবশ্য কলকাতারই একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রাতেই মৃত্যু হয় রাখিদেবী, মুক্তিদেবী ও রানুদেবীর। নন্দ ও সুকুমারবাবু আবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁরা শক্তিনগর জেলা হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। জেলার পুলিশ সুপার শীসরাম ঝাঝারিয়া বলেন, ‘‘পারিবারিক অশান্তির জেরে ওই পরিবারের ছেট বউ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। সেই আগুন নেভাতে গিয়েই পুড়ে যান পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।’’

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, নন্দ দিন মজুরের কাজ করেন। তাঁর বছর তিনেকের ছেলে শ্রীজিতের স্নায়ুর সমস্যা আছে। এই কারণে তার চিকিৎসার জন্য ভালো পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হয়। সংসারে অভাব। সব মিলিয়ে নন্দর সঙ্গে তার স্ত্রী রাখির প্রায় দিনই গন্ডগোল লেগে থাকত। প্রতিবেশীদের দাবি, এমনিতেই রাখির মাথা হঠাৎ করেই গরম হয়ে যেত। সেই সময় তার নিজের উপরে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকত না। প্রচণ্ড চিৎকার করতেন। আবার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে সব ঠিকঠাক। দিন দু’য়েক আগে ছেলের গলায় মাছের কাঁটা ফুটে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দু’জনের মধ্যে আশান্তি শুরু হয়। সোমবার বিকেলে তিনি জাহাঙ্গিরপুরে বাপের বাড়িতে চলে যান ছেলেকে নিয়ে। মঙ্গলবার বিকেলে মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে আসেন মুক্তিদেবী। এই দিন বিকেলেই শান্তিপুরের ফুলিয়া থেকে মামার বাড়িতে বেড়াতে আসে‌ বছর বাইশের শুক্লা ঘোষ।

ঘটনার থেকেই কানাইবাবু যেন ঘোরের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘‘আমি মাটির ঘরের বারান্দায় বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি নন্দ নিজের ঘরের দরজায় জোরে ধাক্কা মেরে চিৎকার করে খোলার জন্য বলছে। এরই মধ্যে বৌমার মাও ছুটে এসেছেন। দু’জনে মিলে দরজা ভেঙে ফেলতেই দেখি ঘরের ভিতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ধানের বস্তার আড়াল থেকে দেখতে পাই ওদের দু’জনের গায়েও আগুন লেগে গেল। বড় খোকা আর বৌমাও ছুটে গেল ঘরের ভিতরে। নাতনিটাও। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। লোক ডাকতে ছুটে গেলাম। তারপর আর কিছুই জানি না।’’

এরই মধ্যে সকলকে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখে কাকার ছেলে শ্রীজিৎকে নিয়ে নিজেদের ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় বছর সাতেকের শ্রেয়া। খাটের ভিতরে ঢুকে যায়। বুধবার দুপুরেও তারা চোখে মুখে আতঙ্ক। ঠাকুমার কোলে সেঁধিয়ে গিয়ে মাঝে মধ্যেই ডুকরে উঠছে সে। বারবার আঁকড়ে ধরছে পাশের মানুষটাকে। নন্দ ঘোষের ঘরের পাশেই দাদা সুকুমার ঘোষের ঘর। একই ছাদের নীচে। শ্রেয়া বলে, ‘‘আমি খাটের উপরে বসে পড়ছিলাম। পাশে খেলছিল ভাই। হঠাৎ দেখি বাইরে আগুন। আগুনগুলো ঘুরছে। ভয়ে আমি ভাইকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে খাটের নীচে ঢুকে যাই।’’

গোটা বাড়িতে এই মুহুর্তে এই দুই শিশু আর দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা। আত্মীয়স্বজ‌নরা আসতে শুরু করেছেন একে একে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সকলেই প্রায় বাকরুদ্ধ। কানাইবাবুর স্ত্রী বৃদ্ধা নিবেদিতাদেবী বলেন, ‘‘ছোট বউমার মাথাটা খুব গরম ছিল। অল্পেতেই রেগে যেত। আগেও রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। হয় তার মা ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে না হয় আমার ছেলে গিয়ে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু একবারও ভাবতে পারিনি যে এমনটা একটা সর্বনাশের কাজ করে বসবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘রাগ হলেই বলত গোটা পরিবার শেষ করে দেব।’’ তার পর কিছুটা থেমে তিনি বলেন, ‘‘নাতনিটাতে ফোন করে ফুলিয়া থেকে ডেকে এনেছে ছোট বউমাই। কী জানি কিছুই বুঝতে পারছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fire Accident Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE