Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বৃদ্ধাকে গ্রামছাড়া করার নিদান ওঝার

পাড়ার লোকেরা সন্দেহ করছিলেন ডাইনি। ওঝা এসে আঁকিবুঁকি কেটে বলেছিলেন, ‘ডাইনি নয়, দৃষ্টি খারাপ, গ্রাম থেকে তাড়াতে হবে।’ নাকাশিপাড়ার ধর্মদায় মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে আশ্রিতা বছর পঁয়ষট্টির বৃদ্ধা ভেবে পাচ্ছেন না, এই বয়সে যাবেন কোথায়?

মনিরুল শেখ
নাকাশিপাড়া শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

পাড়ার লোকেরা সন্দেহ করছিলেন ডাইনি। ওঝা এসে আঁকিবুঁকি কেটে বলেছিলেন, ‘ডাইনি নয়, দৃষ্টি খারাপ, গ্রাম থেকে তাড়াতে হবে।’ নাকাশিপাড়ার ধর্মদায় মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে আশ্রিতা বছর পঁয়ষট্টির বৃদ্ধা ভেবে পাচ্ছেন না, এই বয়সে যাবেন কোথায়?

প্রত্যন্ত কোনও এলাকা নয়। নদিয়ার জেলাসদর কৃষ্ণনগর থেকে মেরেকেটে ২৫ কিলোমিটার দূরে পাকা রাস্তার ধারেই গ্রাম। সর্দারপাড়াটা একটু ভিতরে অবশ্য। শনিবার ওই আদিবাসী পাড়ায় রীতিমতো ওঝা ডাকিয়ে ঝাড়ফুঁক করা হয়েছে বৃদ্ধার। সব জেনেও চুপ করে বসেছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। আর ব্লক প্রশাসনের দোহাই, তাদের কেউ কিছু জানায়নি। রাতে অবশ্য পুলিশ খবর পেয়ে গিয়েছিল গ্রামে। বৃদ্ধাকে আশ্বস্তও করে এসেছে পুলিশ। কিন্তু আদিবাসী পাড়ার নিয়ম মতো, মানতেই হবে সালিশির সিদ্ধান্ত। তাই পুলিশি আশ্বাসেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না বৃদ্ধা।

আদিবাসী ওই পাড়ায় সকলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খারাপ নয়। সেনাবাহিনী বা পুলিশে চাকরি করা লোকজনও আছেন পাড়ায়। কলেজ, হাইস্কুলে পড়া ছেলেমেয়েরাও রয়েছে। তারপরেও এলাকার সিংহভাগ লোকজন পড়ে আছেন সেই ওঝা, গুণিন, ডাইন প্রথার যুগে।

বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধা বয়সজনিত কারণে রোগে ভুগছিলেন। মাস তিনেক আগে ধর্মদায় জামাই বাড়িতে এসে ওঠেন তিনি। জামাই টিনের চালার একটা ছোট ঘর করে দেন পাশে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই গ্রামে রটে যায়, ওই বৃদ্ধা নাকি তন্ত্রমন্ত্র জানেন। ভূত-পেত্নী বার করতে পারেন রাতের অন্ধকারে। সেই ভূতের আঁচড়ে গ্রামের কচিকাঁচারা অসুখ-বিসুখে পড়ছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস গ্রামবাসীর। এই নিয়ে কিছু দিন ধরেই বৃদ্ধা ও তাঁর মেয়ে-জামাইকে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাচ্ছিলেন পাড়ার লোকেরা। শনিবার ঠিক হয় ওঝা এসে বৃদ্ধাকে পরীক্ষা করে যাবেন। বিকেল তিনটে নাগাদ প্রায় চার কিলোমিটার দূরের দহখোলা গ্রামের ওঝা কাঞ্চন মোল্লা সর্দারপাড়ায় আসেন। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বৃষ্টি থামার পর নাইলনের লুঙ্গি, সাদা রঙের ফতুয়া পরা কাঞ্চন থলি হাতে নামেন আসরে। একজনের বাড়ির নিকোনো উঠোনে বসে কাঁসার থালা পেতে গ্লাসে জল ভরেন তিনি। জলে অনবরত ফুঁ দিতে-দিতে মাটির ভাঁড়ে আগুন ধরিয়ে ধুপ-ধুনো দেওয়া হয়। এরপর খোলামকুচি দিয়ে চারটি ঘর কেটে মন্ত্র জপতে থাকেন ওঝা। ঘণ্টাখানেক ধরে বিড়বিড় করার পর ডাকা হয় ওই বৃ্দ্ধাকে। ওঝার কথায় এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস জল খেয়েও দেখান বৃদ্ধা। সব শেষে ওস্তাদ কাঞ্চন উঠোনভর্তি লোকজনের মাঝে ঘোষণা করেন, বৃদ্ধা ডাইনি নন। তবে তাঁর চোখের দৃষ্টি খারাপ। তাই গ্রামে অশুভ শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিকার হিসাবে বৃদ্ধাকে গ্রামছাড়া করার সালিশি দেন ওঝা। ‘দাক্ষিণ্য দেখিয়ে’ সোমবার পর্যন্ত গ্রাম ছাড়ার সময় দেন পাড়ার লোকেরা।

সালিশি চলাকালীন বৃদ্ধার জামাইয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয় গ্রামবাসীর। মেয়ে-জামাইকে বিপদে দেখে বৃদ্ধা পড়েছেন চরম আতান্তরে। ভাঙাচোরা দু’কামরার ঘরের অপ্রশস্ত বারান্দায় বসে তিনি বলেন, “আমার কেউ নেই। মেয়ে-জামাই দেখাশোনা করবে বলে ডেকে এনেছিল। এখন গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে ওরাও বিশেষ কিছু বলতে পারছে না। আমি না গেলে জ্বালাতন বাড়বে। কী করব বুঝতে পারছি না।” তাঁর কথায়, “মিথ্যে সন্দেহের বশে আমাকে অপমান করা হল। অসহায় জেনেও মাথা গোঁজার ঠাঁই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এরা কেমন মানুষ?”

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কী করছেন? ধর্মদা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের শ্যামসুন্দর দে বলেন, ‘‘ওই পাড়ার লোকজন আমাকেও সালিশি সভায় যেতে বলেছিল। আমি অবশ্য শনিবার গ্রামে ছিলাম না।” ওঝা নিয়ে এসে বৃদ্ধাকে তাড়ানোর চেষ্টার নিন্দা করলেও তা রোখার কথা মুখে আনলেন না প্রধান। বরং আদিবাসী পাড়ার বিষয়ে মাথা না ঘামানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হয়েছে তাঁর। নাকাশিপাড়ার বিডিও হেমন্ত ঘোষ বলেন, “আমি জানতাম না এই ধরনের ঘটনা এখনও ঘটছে। আমি নিজে ওই গ্রামে গিয়ে লোকজনদের বোঝাবো।” আর নদিয়া জেলার বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিবর্তন ভট্টাচার্য বললেন, এই নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এলাকায় সভা করবেন তাঁরা।

এতদিনেও গ্রাম্য কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা গেল না কেন, তার জবাব অবশ্য মেলেনি।

অন্য বিষয়গুলি:

manirul shekh nakashipara homeless woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE