সেই বিগ্রহ। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার ...।
কালিদাস রায়ের কবিতার বৃন্দাবন নয়, এ বছর অন্ধকার হয়ে গিয়েছে কৃষ্ণনগর। রাজবাড়ির কুলদেবতা গোপীনাথ থাকছেন না বারোদোলের মেলায়। এই মেলার আগে প্রতি বছর অগ্রদ্বীপ থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ আসে কৃষ্ণনগরে। প্রায় চারশো বছরের পুরনো প্রথা। কিন্তু এ বার অগ্রদ্বীপ মন্দির কমিটি ফেরাতে রাজি হয়নি বিগ্রহ। বর্ধমান ও নদিয়া, দুই জেলার জেলাশাসকের মধ্যস্থতাতেও কাজ হয়নি। শেষ চেষ্টা হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে কৃষ্ণনগর রাজপরিবার। সোমবার সেই আবেদন গ্রহণ করেনি হাইকোর্ট। এ বার নিম্ন আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজপরিবার।
অগত্যা ১১ এপ্রিল থেকে গোপীনাথ-হীন বারোদোলের প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষ্ণনগর। রাজপরিবারের বধূ অমৃতা রায় বলেন, “কিছু মানুষ গায়ের জোরে এত বছরের প্রথাকে ভেঙে দিলেন। কেউ কিছু করতে পারল না। প্রশাসনও না। গোপীনাথ আমাদের কুলদেবতাই নয়, সমস্ত নদিয়াবাসীর আবেগ জড়িয়ে আছে গোপীনাথকে ঘিরে। এই ক্ষত শুকোনোর নয়।”
ক্ষুব্ধ শহরবাসীও। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে চলে আসা এই মেলায় এই প্রথম থাকবে না গোপীনাথের বিগ্রহ। এটা মেনে নিতে পারছেন না কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের শিক্ষক পার্থ স্বর্ণকার। তিনি বলেন, “প্রায় চারশো বছরের একটা ঐতিহ্যে ছেদ পড়তে চলেছে। আচমকা খবরটা পেয়ে সকলেই মর্মাহত।” প্রশাসন কেন মেলার তিন দিনের জন্যও বিগ্রহটি কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসতে পারল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
কেন ফিরলেন না গোপীনাথ? প্রতি বছরের মতো, গত বছর দুর্গা পুজোর পরে রাজবাড়ি থেকে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে অগ্রদ্বীপ গ্রামের বিশিষ্টজনেরা গোপীনাথ বিগ্রহকে নিয়ে যান। চুক্তি অনুযায়ী, আজ, মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বিগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু গত বছরই ওই চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের এক জন রাজবাড়িকে জানান, তাঁরা আর গোপীনাথকে ফেরত পাঠাবেন না। গোপীনাথ অগ্রদ্বীপেরই ভূমিপুত্র। বিগ্রহ কৃষ্ণনগর গেলে আর অগ্রদ্বীপে ফিরবে না, এমন আশঙ্কায় অগ্রদ্বীপের গ্রামবাসীও গণস্বাক্ষর করে বিগ্রহ না- ফেরানোর সিদ্ধান্ত জমা দেন মহকুমাশাসকের কাছে।
বিবাদ মেটাতে সম্প্রতি জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বর্ধমানে দু’পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে প্রশাসনের তরফ থেকে প্রস্তাব ছিল, গোপীনাথের বিগ্রহ থেকে আয় ও ব্যয়ের তত্ত্বাবধান করবেন নদিয়া ও বর্ধমান জেলার দুই জেলাশাসক। বিগ্রহ যাওয়া-আসার ব্যাপারটিও নিয়ন্ত্রণ করবেন দুই জেলাশাসক। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এই প্রস্তাবের পক্ষে কৃষ্ণনগর রাজপরিবার সায় দিলেও, অগ্রদ্বীপ মন্দির কমিটি রাজি হয়নি। তারা ফের বিগ্রহ রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
প্রশাসনের প্রস্তাব মানতে অসুবিধা কোথায় ছিল? অগ্রদ্বীপ গোপীনাথ সেবা ট্রাস্ট সমিতির সম্পাদক জহর দে বলেন, “প্রশাসনকে সামনে রেখে বিগ্রহ নিয়ে গেলেও আর গোপীনাথকে অগ্রদ্বীপে পাঠাত না রাজপরিবার। প্রশাসনও তো আর জোর করে বিগ্রহ আনতে পারত না। আমাদের আইনের আশ্রয় নিতে হত।”
শেষরক্ষার আশায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে রাজপরিবার। কিন্তু সোমবার বেশ কিছুক্ষণ দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার হাইকোর্ট এই আবেদন গ্রহণ করেনি। হাইকোর্টের বক্তব্য, এটা সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত মামলা হলে নিম্ন আদালতে যেতে হবে। না হলে জনস্বার্থ মামলা করতে হবে।
বারোদোলের আগে গোপীনাথকে ফেরাতে না পেরে এ দিন ভেঙে পড়েন রাজপরিবারের সদস্যরা। কৃষ্ণনগরে এ বছরও বারোদোল হবে বটে, তবে সেখানে থাকবে কেবল ১১টি কৃষ্ণবিগ্রহ। শ্বেতচন্দন-শোভিত নিকষ কালো গোপীনাথ বিগ্রহ থাকবে না।
কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা রিনা মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভাবতে পারছি না যে গোপীনাথের সিংহাসন ফাঁকা থাকবে।” কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা লেখক স্বদেশ রায় বলেন, “গোপীনাথ ছাড়া বারোদোলের মেলা অর্ধেক হয়ে যাবে।” আইনি পথে গোপীনাথকে ফেরানোর দাবি করেন তিনি। অন্য দিকে, আদালত মামলা গ্রহণ করেনি, খবর পেয়ে বাজি ফাটিয়ে, আবির খেলে আনন্দ করেন অগ্রদ্বীপের বাসিন্দারা। বারোদোল উৎসবের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন তাঁরা।
কিন্তু কেবল বারোদোলই নয়, গোপীনাথকে হারিয়ে কৃষ্ণনগরে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বারগোড়ার জামাইষষ্ঠী, কৃষ্ণনগরের রথতলার রথ ও রাজবাড়ির জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানও। রথতলা রথ কমিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিবনাথ চৌধুরী বলেন, “আবহমান কাল ধরে আমাদের রথে চড়েন গোপীনাথ। এর সঙ্গে শহরের মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। এটা ‘গোপীনাথের রথ’ বলেই খ্যাত। গোপীনাথ না এলে আমরা হয়তো রথ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy