এক সময়ে রমরমিয়ে চলত এই সব কারখানা। এখন সে সব অতীত। জেনিথ স্টিল।
রাজ্য থেকে আজ যখন একের পর এক শিল্প বিদায় নেওয়ার পথে, শিল্পাঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রথম পর্বে কল্যাণীতে তখন ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের মেরামতি কারখানা ও গবেষণাগার ‘রেডিও ফ্যাক্টরি’। ১৯৫৪ সালে বি ব্লকে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হওয়া সেই রেডিও ওয়ার্কশপ অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবেরটরি এখন দুর্বল পরিকাঠামোর শিকার। প্রজেক্টর, টেলিভিশনের মেরামতি চলে সেখানে। এক সময়ে বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১১ বিঘা জমিতে তৈরি হয়েছিল হ্যান্ডমেড পেপার মিলও। বিভিন্ন ধরনের আর্ট পেপার, বোর্ড তৈরি হত। বর্তমানে এটিরও রুগ্ণ অবস্থা।
১৯৬১ সালে ১ এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন মাপের সুতো তৈরির লক্ষে তৈরি হয়েছিল কল্যাণী স্পিনিং মিল। প্রথম দিন কারখানা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। একই সময়ে সেন-র্যালে সাইকেল, ডেভিডসন ইন্ডিয়া, উড ইন্ড্রাস্ট্রি স্থাপিত হয়। এর পরে ইনচেক টায়ার ফ্যাক্টরি, কল্যাণী ব্রুয়ারিস, কেআর স্টিল, রামস্বরূপ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন তৈরি হয়েছিল। নানা কারণে সব ক’টি কারখানাই কিছু দিন পরে পরে বন্ধ হয়ে যায়। অথবা কোনও মতে এখনও ধুঁকছে। বড় শিল্পের পাশাপাশি ছিল অনেক ছোট শিল্পও। কল্যাণীর বাসিন্দারাই ব্যক্তি মালিকানায় সে সব গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু মূল শিল্পই যেখানে হোঁচট খাচ্ছে, সেখানে সমস্যায় পড়ছেন তাঁরাও। বেঙ্গল ফের, সোমানি, রাবার ফ্যাক্টরি, অ্যান্ড্রুল ইঞ্জিনিয়ারিং, রূপনারায়ণ পেপার মিল, ইন্ডিয়ান অয়েল, আইএফএলের পাশাপাশি কয়েকটি স্টিল কারখানাও তৈরি হয়েছিল এখানে। কিন্তু দুর্গাপুরের থেকে বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি হওয়ায় সমস্যার মুখোমুখি হয় কল্যাণীর স্টিল কারখানাগুলি।
পুরনো শিল্পাঞ্চলের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে প্রবীণ এক শ্রমিক নেতা বলেন, “ইউনিয়নের নেতারা কী করেননি? কর্তৃপক্ষের লোকজনকে মারধর করেছেন। এক শ্রেণির নেতা তোলা আদায় করেছেন। না দিতে চাইলে নানা ভাবে ভয় দেখিয়েছেন। সেই সময়ে অনেক মালিকই আর ভয়ে এ মুখো হননি। দাবি নিয়ে সঠিক ভাবে আলোচনা না করেই ধর্মঘট করেছেন শ্রমিকেরা। এ সমস্ত কারণে বহু কারখানাই বন্ধ হয়েছে।” তিনি জানান, দু’একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুধু আলোচনা করেই তিনি তা খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এক সময়ে।
কল্যাণী শিল্পাঞ্চল নিয়ে কথা হচ্ছিল চার বারের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক এবং বর্তমানে পিডিএসের রাজ্য সভাপতি সুভাষ বসুর সঙ্গে। সুভাষবাবু বলেন, “১৯৬৫ সাল থেকে এই শহরে থাকি। চোখের সামনে সব কারখানা তৈরি হতে দেখেছি। আবার এক এক করে সব শেষও হতে দেখেছি। এক সময় বড়, মাঝারি, ছোট মিলিয়ে শতাধিক কারখানা ছিল। তার অধিকাংশ আজ বন্ধ। সব মিলিয়ে গোটা পাঁচেক ভাল ভাবে চলছে বলা যায়।” কারখানা বন্ধের পেছনে প্রবীণ শ্রমিক নেতার বক্তব্য কার্যত স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, “সব সময়ে শ্রমিকদের বলতাম, উত্পাদন বাড়াতে হবে। অধিকাংশ নেতা ঠিক মতো কাজ করতেন না। কাজ না করে শুধু বেতন নিয়েই বাড়ি ফিরতেন। কারখানার ভিত হতে না হতেই সেখানে ঝাণ্ডা পুতে দিতেন। কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের লোক নেওয়ার দাবি জানাতেন। এ সবে মালিকেরা ভয় পেয়ে কারখানা না করেই ফিরে যেতেন।”
সুভাষবাবু আরও প্রশ্ন তোলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন কারও কাছ থেকে জমি নেবেন না। তাহলে, কল্যাণীতে কারখানা করার জন্য যাঁরা জমি নিয়েও কারখানা করেননি, আইন করে তাঁদের সেই জমি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। সেখানে নতুন করে কারখানা তৈরি হোক। কারখানা না হলে বেকার সমস্যার তো সমাধান হবে না।” ওই শ্রমিক নেতাও বলেন, “বন্ধ কারখানা এক এক সমাজবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মেশিন-পত্র বিক্রি করে দেয় দুষ্কৃতীরা।”
এক সময় বেশ কিছু কারখানায় তিনটি বিভাগেই কাজ হয়েছে। অনেক কারখানায় শ্রমিকরা ওভার টাইম করতেন। কল্যাণী ছাড়াও নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিকেরা এখানে কাজ করতে আসতেন। বেশ কিছু বাস কল্যাণী মেন স্টেশন থেকে শ্রমিকদের কারখানায় নিয়ে আসার জন্য বহাল ছিল তখন। আপ ও ডাউনের ট্রেন থেকে দলে-দলে শ্রমিকরা কল্যাণী মেন স্টেশনে নামতেন। আজ সে সব দৃশ্য অতীত। শিল্পাঞ্চল মানেই বিশ্বকর্মা পুজো। ওই সময়ে প্রতি বছর কারখানাগুলো গমগম করত। চারদিকে আলো, প্যাণ্ডেল মাইকের শব্দ, হইচইয়ে ভরে উঠত গোটা শিল্পাঞ্চল। পুজোকে ঘিরে নাটক, কলকাতার বড় দলের যাত্রা, স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পীদের নিয়ে বিচিত্রানুষ্ঠানে মেতে থাকতেন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের লোকেরা। সঙ্গে থাকত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। আনন্দ ভাগ করে নিতে বিভিন্ন জেলা থকে আসতেন অন্যান্য মানুষজনও।
কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সিপিএম ও তৃণমূলকেই দায়ী করে কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি। সংগঠনের জেলা সভাপতি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিধানচন্দ্র রায়ের হাতে তৈরি কল্যাণী শিল্পাঞ্চল বামফ্রন্টের আমলে শেষ হয়ে গিয়েছে। নতুন সরকারেরও এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই।” তিনি বলেন, “মানস ভুঁইয়া রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্প দফতরের মন্ত্রী থাকার সময়ে স্পিনিং মিলকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। বেশ খানিকটা কাজও এগিয়েছিল। কিন্তু আমরা সরকার থেকে যাওয়ার পরে আর কিছুই হয়নি।”
বছর তিনেক আগে প্রদীপকুমার শূর কল্যাণীর পুরপ্রধান থাকার সময়ে শহরের বিভিন্ন কারখানার কতৃপক্ষকে নিয়ে ঋত্বিক সদনের সেমিনার হলে একটি সভা করেছিলেন। সেখানে জেলা শিল্প কেন্দ্রের আধিকারিক, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি, এস্টেট ম্যানেজার-সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। সে দিন পানীয় জল, রাস্তা-সহ পুরসভার বিষয়গুলি প্রদীপবাবু দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তৃণমূল প্রভাবিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের নেতা মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “বামফ্রন্টের নীতির কারনে আজ কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের এই অবস্থা। শিল্প বজায় রাখার পরিবেশ ওরা শেষ করে দেয়। যে কারণে ৯০টির বেশি কারখানার মধ্যে ৯টি কারখানার চিমনি দিয়েও আজ ধোঁয়া বেরোয় না। এক কালে ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করলেও আজ তার ২০ ভাগও আছেন কিনা সন্দেহ।” তিনি দাবি করেন, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে যে সব কারখানা চলছে, সেগুলিকে অন্তত টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। পরিকাঠামোর উপরেও জোর দিচ্ছে সরকার।
(শেষ)
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর কল্যাণী’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy