পুরনো দিনের সরু রাস্তা। তারই একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে দু’চাকা, চার চাকা। রাস্তা দখলের এই ছবি নতুন নয় কৃষ্ণনগরে। যেটা নতুন, সেটা হল যাত্রী দখলের লড়াই। মানে কে-কত যাত্রী তুলতে পারে তা নিয়ে বাস ও ম্যাজিক গাড়ির লড়াই। কে-কত জোরে চালাতে পারে তা নিয়েও লড়াই আছে দু’পক্ষে। সেই রেষারেষি থেকে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও লেগেই রয়েছে। দু’পক্ষের হাতাহাতি, মারামারি থেকে পরিবহণ ধর্মঘটকী দেখেনি শহর। সব দেখেও হাত গুটিয়েই বসে পুর-কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন।
নদিয়ার জেলা সদর কৃষ্ণনগর শহর। এত বড় শহর, এত পুরনো শহর। অথচ কার পার্কিং বা গাড়ি রাখার মতো কোনও ফাঁকা জায়গা নেই। ফলে রাস্তার এক ধারেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে যে-যার মতো নিশ্চিন্ত। হাইস্ট্রিট, অনন্তহরি মিত্র রোড, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রোড, মনোমোহন ঘোষ স্ট্রিট-সহ বড় বড় রাস্তাগুলিতে দোকানের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। পুরনো শহরের সরু রাস্তার একাংশ এই ভাবেই চলে যায় পার্কিংয়ের দখলে।
এ দিকে, শহরের বাইরে দিয়ে কোনও বাইপাস নেই। বাসস্ট্যান্ডটাও শহরের ভিতরে। ফলে দূরপাল্লার বাস শহরের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেলেও জেলার বিভিন্ন রুটের বাসকে শহরের ভিতরেই ঢুুকতে হয়। আবার করিমপুর, বগুলা বা মাজদিয়া যেতে গেলে শহরের ভিতর দিয়েই যেতে হবে। শহরের বাইরে দিয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। ফলে যানবাহনের চাপে হাঁসফাঁস করছে শহর। তার উপরে শহরের বুকে চলতে শুরু করেছে যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি, লোকে যাকে ম্যাজিক গাড়ি বলে ডাকে।
যাত্রী তোলা নিয়ে বাস ও এই ম্যাজিক গাড়ির মধ্যে শুরু হয়েছে রেষারেষি। কৃষ্ণনগরের বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টেশন পর্যন্ত ‘টাউন সার্ভিস’ বাস রয়েছে মোট ৬টি। মূলত এদের সঙ্গেই লড়াই ম্যাজিক গাড়ির। শহরের বিভিন্ন রুটে ৫৬টি ম্যাজিক গাড়ি চললেও টাউন সার্ভিস বাসের রুটে ১৫টি ম্যাজিক গাড়ি চলে। বাস মালিকদের অভিযোগ, ম্যাজিক গাড়িগুলির নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। বাসের ঠিক আগে গিয়ে তারা যাত্রী তুলে নেয়। নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষ বলেন, “ওদের অত্যাচারে এতটাই লোকসান হচ্ছে যে সম্প্রতি একটি বাস তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি আমরা।”
ম্যাজিক গাড়ির মালিকরা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। নদিয়া মিনি মোটর ড্রাইভার ইউনিয়নের সহ-সভাপতি গোবিন্দ রায় বলেন, “বাস মালিকদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা সময় মতোই গাড়ি ছাড়ি। আমাদের সময়সূচি আছে। তা যাতে মানা হয়, দেখার জন্য আলাদা করে লোকও আছে। ওদের আগে আগে গিয়ে যাত্রী তুলে নিই না মোটেই।”
কাদের দাবি-কতটা যুক্তিযুক্ত জানা নেই, তবে, দু’পক্ষের ঠেলাঠেলিতে রাস্তায় চলা দায় হয়ে উঠেছে পথচারীর। শহরের বিভিন্ন মোড়ে যাত্রী তোলার জন্য ম্যাজিক গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে থাকায় সেখানে যানজট হচ্ছে।
এ ছাড়াও ব্যাটারি চালিত গাড়ি টোটো, অটো, রিকশা, বেসরকারি গাড়ি রয়েছে। সব মিলিয়ে সরু রাস্তায় যানজটে জেরবার শহরবাসী।
শহরের বর্র্ষীয়ান নাগরিক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মিহির দাস বলেন, ‘‘এখন রাস্তায় বের হতেই যেন ভয় লাগে। যে ভাবে শহরের রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে তাতে হাঁটাচলা করতে ভয় লাগে। তার উপরে অকারণ রেষারেষি করে গাড়িগুলো। একটু অসতর্ক হয়ে গেলেই বিপদ।” সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? তৃণমূলের পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন,‘‘রাস্তা চওড়া করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সেটা পারে জেলা প্রশাসন। তবে আমারা শহরের রাস্তায় যানজট কমানোর জন্য থানার সামনে ও চাষা পাড়ায় নতুন বাসস্ট্যান্ডের পাশে কার পার্কিং-এর পরিকল্পনা করছি।” শহরবাসী অবশ্য মনে করছেন, শুধু কার পার্কিং করলে সমস্যা মেটানো যাবে না। শহরের ভিতর গাড়ি ঢোকানো কমাতে হবে। করিমপুর, বগুলা ও মাজদিয়া রুটের বাস, গাড়ি ও লরিগুলিকে শহরের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। শহরের বাইরে দিয়ে একটা বাইপাস করতে হবে।’’ শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে সব রুটের বাস জাতীয় সড়ক দিয়ে যাতাযাত করে, সেই সব রুটের বাস শহরের ভিতরে ঢুকতে না দিয়ে শহরের বাইরে একটা বাসস্ট্যান্ড করা উচিত। তাহলেই শহর অনেকটা যানজটমুক্ত হবে।” আর অবশ্যই বাস ও ম্যাজিক গাড়ির ঝামেলা মেটানোর কথা বলছেন নাগরিকরা।
প্রশাসন কী বলছে?.
কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাসক মৈত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ম্যজিক গাড়ির সঙ্গে বাসের রেষারেষি বন্ধ করতে আমরা দু’পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। আপাতত আমরা চাইছি ম্যাজিক গাড়িরও একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড তৈরি হোক। কিন্তু শহরের ভিতরে তেমন উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy