গুরুপদ বিশ্বাসের বাড়িতে এই ভাবেই ভাঙচুর হয়েছে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
এলাকা দখল নিয়ে ঝামেলা। তারই জেরে বিজয়মিছিল থেকে হামলা চালিয়ে তৃণমূলের দুই কর্মীকে পিটিয়ে মারল দলেরই অন্য গোষ্ঠীর লোকজন। শুক্রবার বিকেলে নদিয়ার হাঁসখালির ভৈরবচন্দ্রপুর গ্রামে ওই ঘটনার পরে আতঙ্কের ছায়া নেমে এসেছে। রাত থেকেই থমথমে গোটা গ্রাম। সকালে আতঙ্কে কেউ হাটমুখো হননি। বন্ধ ছিল দোকান-পাট।
মৃত গুরুপদ বিশ্বাস (৫০) ও শ্যামল বিশ্বাসের (৪০) পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের না হলেও হাঁসখালি থানার পুলিশ স্থানীয় বেতনা-গোবিন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সোহাগী মণ্ডল ও তার স্বামী কুমারেশ মণ্ডল-সহ দশ জন তৃণমূলকর্মীর বিরুদ্ধে পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে মিছিল করে খুন, বাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের সুয়োমোটো করেছে। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্তরা পলাতক।
জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণার পরে কিছু লোক মিছিল করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে অন্য এক পক্ষের গণ্ডগোলে ঘটনাটি ঘটেছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়েছে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকা দখল নিয়ে বেতনা-গোবিন্দপুর পঞ্চায়েতের এক সদস্য ও উপপ্রধানের মধ্যে মূল গণ্ডগোল। দু’জনে লাগোয়া দুই গ্রামের বাসিন্দা। ভৈরবচন্দ্রপুর গ্রামে বাড়ি পঞ্চায়েত সদস্য সোহাগী মণ্ডলের। লাগোয়া গ্রাম রায়পুরে বাড়ি উপপ্রধান অরবিন্দ বিশ্বাসের। মাস কয়েক আগে ভৈরবচন্দ্রপুর গ্রামের কয়েকজন সিপিএমকর্মী তৃণমূলে যোগ দেন। এর মধ্যে সুকুমার ও শ্যামল উপপ্রধানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কয়েকজন অন্য গোষ্ঠীর। পাল্লা কাদের ভারী হল, তাই নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল। সম্প্রতি একটি খাসজমির দখল ঘিরে দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল বেধে যায়।
শুক্রবার বিকেলে রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পরে গ্রামে মিছিল বের করেন সোহাগীদেবী ও তাঁর স্বামী-সহ প্রায় শ’তিনেক তৃণমূল সমর্থক। বিশাল মিছিলটা এগিয়ে গিয়ে পাশের রায়পুরে যায়। ওই গ্রামে তখন আর একটি বিজয় মিছিল বের করার প্রস্তুতি চলছিল। সেখানে ছিলেন সুকুমার ও শ্যামল। ভৈরবচন্দ্রপুর গ্রামের মিছিল ওই গ্রামে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। সুকুমার ও শামলকে তাড়া করেন মিছিলের লোকেরা। ছুটতে-ছুটতে সুকুমারবাবুর বাড়িতে ঢুকে পড়েন দু’জনে। সুকুমারবাবুর দাদা তৃণমূলকর্মী গুরুপদ বিশ্বাস ও জগদ্বন্ধু বিশ্বাসও ওই বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপরেই ওই বাড়ি ঘিরে শুরু হয় ইট বৃষ্টি, বোমাবাজি। অভিযোগ, বাড়ির মধ্যে ঢুকে চার জনকে বাঁশ দিয়ে পেটাতে শুরু করে মিছিলের উন্মত্ত জনতা। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে সুকুমারবাবুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে পুলিশের উপরেও চড়াও হয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধরা। সুকুমারবাবুকে কোনও রকমে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। ঘরের ভিতরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন গুরুপদবাবু। শ্যামলবাবুকে পিটিয়ে রাস্তার উপরে ফেলে রাখা হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হামলাকারীরা চলে গেলে দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশের উদ্যোগে অটোতে দু’জনকে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতে সেখানেই দু’জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ, সশস্ত্র ওই মিছিলটি এরপরে গ্রামের মন্টু টিকাদার ও শেফালি টিকাদারের বাড়িতে হামলা চালায়। ওই দু’জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
উপপ্রধান অরবিন্দ বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘সম্প্রতি আমরা পঞ্চায়েত থেকে একটি খাস জমি উদ্ধার করে ১২ জন গরিব মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি। সেই রাগে পরিকল্পনামাফিক হামলা চালিয়ে আমাদের দুই কর্মীকে খুন করা হয়েছে।” ওই গ্রামের বাসিন্দা সিপিএম-এর হাঁসখালি জোনাল কমিটির সদস্য প্রশান্ত রায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘খাস জমি বণ্টনের সময় মোটা টাকা লেনদেন হয়েছে। সেই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়েই নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরে এই খুন।” তৃণমূলের নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের সমর্থকরা গোটা ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলেই অভিযোগ পাচ্ছি। সাংগঠনিক ভাবে আমরাও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’’
এরই মধ্যে শনিবার বিশ্বজিৎ বিশ্বাস নামে গ্রামের এক যুবকের গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। গ্রামের অনেকেই দাবি করতে থাকেন, শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনার জেরে এই অস্বাভাবিক মৃত্যু। যদিও পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে ‘সুইসাইড নোট’। সেখানে প্রণয়ঘটিত কারণের কথাই উল্লেখ করেছেন ওই যুবক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy