এ যেন এক উলটপুরাণ। সারা দেশ যখন মোদী হাওয়ায় ভাসছে, তখন বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে রইল মুর্শিদাবাদ।
সীমান্ত জেলার তিনটি লোকসভা আসনে (বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর) দলের শক্তি বৃদ্ধি তো কোন ছার, তাদের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্কও ধরে রাখতে পারল না বিজেপি। রাজ্যে এবারে যেখানে বিজেপির ভোটের অঙ্ক ১৬.৮ শতাংশ ছাড়াল, সেখানে এই জেলার তিন আসনে বিজেপি গড় ভোট নামল ৭.৯ শতাংশে। শুধু তাই নয়, তিনটি কেন্দ্রেই এবারে জামানত জব্দ হয়েছে তাদের। বিজেপি নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছেন, হারটা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছে। অধীরের সাংগঠনিক দক্ষতার কাছে।
প্রায় ৬৫ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯৮৯ সাল থেকে বিজেপি-র ভোটব্যাঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৮৪ সালে যেখানে জঙ্গিপুরে ২.৭৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি, ১৯৮৯ সালে সেখানে ১১.৫ শতাংশ ও ১৯৯১ সালে ১৮.৪২ শতাংশ ভোট পায় তারা। একই ভাবে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে ১৯৮৪ সালে ২.৯ শতাংশ থেকে ভোট বেড়ে পরের দু’দফায় হয় যথাক্রমে ৪.১৫ ও ১১ শতাংশ। বহরমপুরে ১৯৮৪ সালে ২.২১ শতাংশ বিজেপি-র ভোট ১৯৯১ সালে ২০.২৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৮ সালে বহরমপুর কেন্দ্রে বিজেপি-র ভোট ছিল ৩০.২৫ শতাংশ। তবে, ১৯৯৯ সালে সেই ভোট কমে ১৪.৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর ২০০৪ পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীই দেয়নি জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদে। বহরমপুরে প্রার্থী দিলেও ২০০৪ ও ২০০৯ সালে অধীর চৌধুরীর সাংগঠনিক দাপটে বিজেপি-র দাঁত ফোটানোর কোনও জায়গা ছিল না। ২০০৪ সালে বহরমপুরে বিজেপি পায় ৪.১৮ শতাংশ ভোট, ২০০৯ সালে ২.৯ শতাংশ। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুকে ঘিরে প্রবল অশান্তি দেখা দেয় জঙ্গিপুরে। বিজেপির ভোট এক লাফে ফের বেড়ে যায় ১০ শতাংশে।
এবারে পরিস্থিতিটা ছিল একটু অন্য। মোদী হাওয়ায় সারা দেশে, এমনকী এ রাজ্যে বেসামাল কংগ্রেস ও বামেদের দুর্গ। তা সত্ত্বেও সেই ঝড়ের বিন্দুমাত্র আঁচ লাগল না মুর্শিদাবাদের গায়ে। জেলার তিনটি আসনের কোথাও সে ভাবে পদ্মফুলের গন্ধ ছড়াল না রাজনীতির মঞ্চে। বিজেপি-র মুর্শিদাবাদ দক্ষিণ অংশের সভাপতি মালা ভট্টাচার্য মেনে নেন, “মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরীর সাংগঠনিক দক্ষতার কাছে গত দশ বছর ধরে বিজেপির পিঠ দেওয়ালে ঠেকে আছে। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করতে পারা যায়নি দলের মধ্যে। ফলে হাওয়া থাকলেও তা পালে লাগানো যায়নি।” দলের মুর্শিদাবাদ উত্তর অংশের সভাপতি ষষ্ঠীচরণ ঘোষও মনে করেন, “শুধু হাওয়া দিয়ে ভোট হয় না। হাওয়া উঠলে সেখানে একজন সবল কাণ্ডারি দরকার যিনি পাল ধরে রেখে হাওয়া লাগিয়ে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই জেলায় তা নেই। তাই বিজেপির শক্তি জেলায় ক্রমশ কমেছে।” জঙ্গিপুরে বিজেপির পরাজিত প্রার্থী সম্রাট ঘোষ আবার মনে করছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যথাযথ গুরুত্ব দেননি। তিনি বলেন, “প্রচারে গিয়ে দেখেছি সর্বত্রই ঝড় উঠেছে। কিন্তু ভোট করানোর মতো কায়দা ও লোকবল থাকা দরকার। যার অভাব আছে এ জেলায়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অনুরোধ করেছিলাম জেলায় কেন্দ্রীয় স্তরের নেতাদের প্রচারে পাঠাতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। মোদীজিকে আনতে বিশাল পরিমাণে আর্থিক খরচ বহন করার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তবু জঙ্গিপুর, লালবাগ, করিমপুর ইত্যাদি শহরাঞ্চলে ব্যাপক ভোট পেয়েছি আমরা। এটা দলের কাছে শুভ সঙ্কেত।”
এই শুভ সঙ্কেতকে আঁকড়েই বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করছে বিজেপি। অধীর-গড়ে সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে বলবে সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy