সপরিবারে বন্ধুপ্রকাশ।
নির্বিকার মুখ, সরল হাসি, জেরা শেষ হলে ভাবলেশহীন গলায় বার বার বলছে— ‘আসছি স্যর তা হলে!’
সোমবার বার বার তলব করার সময়ে একটুও বিরক্তির ভাঁজ দেখা যায়নি তার কপালে। বরং এ পার থেকে ‘আর এক বার আসতে পারবে থানায়, অসুবিধা নেই তো...’ বললে পাল্টা উত্তর এসেছে, ‘না স্যর, অসুবিধার কি আছে!’
ঈষৎ চাপা রং, দোহারা চেহারার উৎপল বেহেরা ভেঙে পড়েছিল মধ্য রাতে। সেই উত্তাপহীন মুখ থেকে তখন খই ফুটছে। তদন্তকারী অফিসারেরা বলছেন, ‘‘আমরা তো প্রথমে অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। এত দ্রুত সব বলে দেবে ভাবতে পারিনি।’’
পুলিশের দাবি— তাদের জেরায় ভেঙে পড়ার পরে নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারেনি সে, বলতে থাকে, ‘যা করেছি, ঠিক করেছি। হ্যাঁ, বদলা নিয়েছি। আমাকে অপমান করার ঠেলা বোঝ এ বার, শা...ধাপ্পাবাজ! ভাবতে পারেন, আমাকে বলছে, ‘ছোটলোক ছোটলোকের মতো থাকবি!’ আমিও বলে দিয়েছিলাম, ‘এ বার ছোটলোকি কাকে বলে দেখ!’’
জিয়াগঞ্জে শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল সপরিবার খুনের পরে পুলিশ যখন হন্যে হয়ে খোঁজ করছে আততায়ীর, তির যখন প্রায় গাঁথা হয়ে গিয়েছে বন্ধুপ্রকাশের এক ব্যবসায়িক সহযোগীর দিকে, ঘটনার মোড় ঘোরে তখনই। আসলে, একটা ছোট্ট ‘মিথ্যে’ কথাই ধরিয়ে দেয় উৎপলকে। এমনই মনে করছেন তদন্তকারীরা।
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘টাওয়ার লোকেশন বলছে, দশমীর সকালে জিয়াগঞ্জে ছিল উৎপল, অথচ নির্বিকার মুখে ও বলে গেল সাগরদিঘিতে মোবাইল সারাতে গিয়েছিল। সন্দেহটা দানা বাঁধল
সেখান থেকেই।’’
পুলিশের জেরার মুখে উৎপল জানান, ওই দিন দুপুর ১২টা ৬ মিনিট নাগাদ লেবুবাগানে বন্ধুপ্রকাশের দরজার কড়া নাড়তেই খুলে দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। ‘স্যর, দাঁড়ান কাগজপত্রটা বের করি’, বলেই ব্যাগ থেকে হাঁসুয়া বের করে কোপাতে থাকে সে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিনটে খুন সেরে ফেলেছিল সে! এমনই দাবি তার।
এই সময়ে দুধ বিক্রেতা রাজীব দাস ঘানির তেল নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। দরজা খুলে ফেলতেই বিপদ বুঝে উৎপল লুকিয়ে পড়ে রান্নাঘরে। তার পরে রাজীব চিৎকার করতে শুরু করলে পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে পালায়। পালানোর সময় বিমার কাগজ আর জুতো ফেলে যায়। তার পর হরি মন্দিরের পাশে রক্তমাখা গেঞ্জি বদল করে প্রথমে সদরঘাটে বোনের বাড়িতে চলে আসে উৎপল। সেখান থেকে আজিমগঞ্জ এসে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে স্নান করে খেয়ে ঘুমিয়ে পরে।
টানা পাঁচ দিন ধরে এমন নিরুত্তাপ থাকলে কী করে? পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, ‘যা করার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম, যা হওয়ার হবে। আমি আমার কাজ করেছি।’
নিতান্তই সাদামাটা নির্বিরোধী ছেলেটির এমন পরিবর্তন হল কী করে, তার উত্তর হাতড়াচ্ছেন পড়শিরাও।
গ্রামের মানুষ ওই যুবককে উৎপল নয়, মনোজ নামেই চেনেন। বাবা মাধব বেহেরার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ দিয়েই তার রোজগারের শুরু। পরে সে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করে।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও পাড়ায় অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে বলেই পরিচিতি ছিল তার। সে যে এ কাজ করতে পারে তা মানতেই পারছেন না তাঁর প্রতিবেশীরা। হুমায়ুন শেখ বলেন, “উৎপল খুব হাসিখুশি ছেলে। যদি সে খুন করবে তা হলে তার শরীরী ভাষায় প্রকাশ পেত। ঘটনার সাত দিন পরেও আমরা কিচ্ছু টের পাইনি। আমার তো কেমন সন্দেহ হচ্ছে!’’ এমনকি বন্ধুপ্রকাশের মামা দুলাল ঘোষকেও বলতে শোনা যায়, “এটা কী হল, সাতকাণ্ড রামায়ন পড়ে শেষে কিনা সীতা রামের মাসি! এটা বিশ্বাস করা যায় না।”
তবে, গ্রামবাসীদের আলোচনায় কান পাতলে উৎপলের এই তীব্র আক্রোশের অন্য একটি কারণও উঠে আসছে। পাড়ার এক মাঝবয়সী পড়শি বলছেন, ‘‘ওই শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কের জেরেই উৎপলের বড় বোনের প্রথম বিয়ে ভেঙে যায়। আজিমগঞ্জ থেকে ফিরে আসার পরে সাহাপুরের বাড়িতেই থাকত সেই মেয়েটি।’’ বন্ধুপ্রকাশের এক বন্ধুর দাবি, ‘‘উৎপলের বোনের ফের বিয়ে হয় বছর তিনেক আগে। এ বার জিয়াগঞ্জে। দেড় বছর আগে সেখানেই বাড়ি করে উঠে যায় বন্ধুপ্রকাশ। ফলে তা নিয়ে ফের গ্রামে ফিসফাস শুরু হয়।’’ এ ব্যাপারে জেলা পুলিশের এক কর্তাও বলেন, ‘‘শুধুই টাকা নয়, সম্পর্কজনিত একটা আক্রোশও উৎপলের মধ্যে কাজ করেছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy