ফুরফুরা শরিফে ত্বহা সিদ্দিকির কাছে এক দিনে দুই নেতা। ছবি: দীপঙ্কর দে
দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দিন ধরেই বেসুরো বাজছেন মুকুল রায়। এ বার সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মজবুত ভোটব্যাঙ্কেই আঘাত হানতে এগিয়ে এলেন তিনি। সংখ্যালঘু উন্নয়নে মমতার সরকার কার্যত কিছুই করতে পারেনি বলে দলকে বিঁধলেন তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
হুগলির ফুরফুরা শরিফে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিকে পাশে নিয়ে মুকুলের মন্তব্য, বর্তমান রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা পূরণের ধারেকাছে যেতে পারেনি।
বিজেপি-র উত্থানে সংখ্যালঘু ভোটকে নিজেদের দিকে টানায় সচেষ্ট তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষে বিষয়টা কম অস্বস্তির নয়। ঘটনাচক্রে মুকুলের আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই শনিবার ফুরফুরা শরিফ ঘুরে গিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে যিনি এখন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ। তার পরেও মুকুলকে ঘিরে যে আবেগ দেখাল ফুরফুরা, সেটা তৃণমূলের অন্দরে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার বার্তাই দিয়ে রাখল। মুকুলও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মনে করিয়ে দিলেন, “দল কার হাতে থাকবে, তা এমপি, এমএলএ-রা ঠিক করেন না। শুধু ভালবাসলে হবে না, মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদার কথা ভাবতে হবে।”
লোকসভা ভোটের পরে এ রাজ্যে বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই মমতা সংখ্যালঘু তাস আরও বেশি করে খেলতে শুরু করেছেন। বিজেপির মোকাবিলায় তাঁর দলই যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারে, দলনেত্রীর এই ধারাবাহিক প্রচারের ফায়দা ভোটের বাক্সেও পেয়েছে তৃণমূল। ঠিক এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রশ্নে মুকুল উল্টো সুর গাইলেন! শুক্রবারই ত্বহা মন্তব্য করেছিলেন, বর্তমান রাজ্য সরকার যে উন্নয়ন করছে, তা তাঁদের কাছে ভিক্ষে বলে মনে হয়। কোনও অধিকার তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁর সেই সুরই এ দিন জোরালো হয়ে উঠল মুকুলের কথায়, মনে করছেন তৃণমূলের একাংশ।
ঘটনাচক্রে দিন কয়েকের মধ্যে ত্বহার সঙ্গে মুকুলের এটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। গত ১ মার্চ রাতেও ফুরফুরায় এসে ত্বহা সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন মুকুল। তার পরেই দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠেন মমতা। তাঁর দূত হয়ে পুরমন্ত্রী এখানে এসে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ফুরফুরা শরিফে উন্নয়ন পর্ষদ তৈরির কথা ঘোষণা করেন। শনিবার সন্ধ্যায় সাংসদ অপরূপা পোদ্দারকে নিয়ে ফের আসেন ফিরহাদ। তিনি বলেন, “ফুরফুরায় আরও উন্নয়নের দরকার।” নাম না করে মুকুলকে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি তিনি। বলেছেন, “কেউ এই সময় আসেন ছবি তুলতে, আমি আসি দোয়া নিতে!” এর পরেই মাঝরাতে মুকুলের পুনঃপ্রবেশ।
পুরমন্ত্রীর ‘বাউন্সার’ ক্রিকেট-প্রিয় মুকুল অবশ্য সামলে দিয়েছেন দ্রাবিড়ের কায়দায় ডিফেন্স খেলে। দাবি করেছেন, “ফুরফুরায় আমার আসা নিয়ে যাঁরা রাজনৈতিক তাৎপর্য খুঁজছেন, ভুল করছেন। প্রায় ১৮-২০ বছর আসছি এই উরস উৎসবে। আমি সব থেকে পুরনো মানুষ, যে এই পীঠস্থানে আসছি! এ বারও এলাম। তবে একটু রাত হল।” ত্বহার সঙ্গে একান্তে প্রায় আধ ঘণ্টা কথা বললেন মুকুল। তার আগেই সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, “সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশের আশা ছিল, অন্তত প্রত্যাশার ধারেকাছে যাবে সরকার। পেরেছে কি? পারেনি।” নিজেই আবার কথাটির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “কিছু কাজ হয়েছে। কিছু কাজ হয়নি। কিছু কাজ বাকি আছে। কুমিরের কান্না নয়, সংখ্যালঘু মানুষ যে সংখ্যালঘু, এটা যেন ভাবতে না হয়!”
মুকুলের এই মন্তব্য নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি হয়। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া না জানালেও বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, মমতার সংখ্যালঘু-দরদী ভাবমূর্তিকেই মুকুল পরোক্ষে ‘কুমিরের কান্না’ বলে কটাক্ষ করেছেন। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক, বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য যেমন এ দিন বলেন, “বিভিন্ন দল বারবারই সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে।” মুকুলের কথায় সেই বাস্তবতাই ফুটে বেরিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ফুরফুরার রেল প্রকল্প নিয়েও মমতাকে বিঁধেছেন মুকুল। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ডানকুনি-ফুরফুরা শরিফ রেললাইন পাতার ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এলাকার মানুষের আশা ছিল, শীঘ্রই ট্রেন ছুটবে সেই লাইন ধরে। কিছুটা কাজ শুরু হয়ে তা থমকে যায়। মুকুলের মন্তব্য, “রেলের মানচিত্রে ফুরফুরা শরিফকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী কালে রেলমন্ত্রী হয়ে আমিও চেষ্টা করেছিলাম। আশা ছিল, আমি থাকাকালীন কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারব। তা পারিনি, এটা ঠিক।”
রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে রবিবারই দিল্লি গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর এই যাওয়াকে ‘ইতিবাচক’ আখ্যা দিয়েও শনিবার মুকুলের খোঁচা ছিল, এটা আর একটু আগে হলে ভাল হতো! ফুরফুরার রেল প্রকল্প নিয়েও একই সুর শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। মুকুল বলেছেন, “২০১০ সালে ওই প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল। কার জন্য তা হয়নি, কেন হয়নি, সেই বিতর্কে না গিয়ে এখন আমাদের যা করণীয়, তা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে গিয়ে বোঝানো যে, এই প্রকল্প কতটা জরুরি। আমি নিজে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হব।”
এত দিন কি তবে রাজ্যের তরফে তদ্বিরে খামতি ছিল? মুকুলের জবাব, “বললামই তো, বিতর্ক পাশে সরিয়ে রাখতে চাইছি! সহমতের ভিত্তিতে যাতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা যায়, সেই লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy