হাসিমুখে পাশাপাশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার নজরুল মঞ্চে দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।
সৌজন্য বজায় রইল ষোলো আনা। কিন্তু তার আড়ালে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়লেন না! নজরুল মঞ্চ থেকে শুরু করে রাজভবন পর্যন্ত।
বলটা প্রথম ছুড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। ব্যাঙ্ক পরিষেবাকে দেশের প্রতিটি বাড়ির দরজায় নিয়ে যাওয়াকে তাঁর সরকারের অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চালু করেছেন বিনা আমানতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জনধন প্রকল্প। কিন্তু এ দিন নজরুল মঞ্চে দু’টি বিমা এবং একটি পেনশন প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতার কটাক্ষ, ‘‘রাজ্যের সাড়ে তিন হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে এক হাজারটিতে ব্যাঙ্কিং পরিষেবাই পৌঁছয়নি। কেন্দ্রকে বলছি, সব গ্রামে না হোক, অন্তত প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করুন।’’
জবাব দিতে সময় নেননি মোদী। মমতার বলে কার্যত ওভার বাউন্ডারি মেরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এটা নিশ্চয়ই ৬০ বছরের হিসেব। ওঁর দুঃখ আমি বুঝি। উনি আমার সামনে এ কথা বললেন। কারণ জানেন পারলে, ইনিই পারবেন। মানে আমার উপর ওঁর ভরসা আছে।’’
প্রধানমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি, তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ। মঞ্চে আসীন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ তখন দৃশ্যতই ভার।
তবে এর পরেও রাজভবনে বজায় ছিল সৌজন্যের সুর। এবং নিজের অবস্থানে অনড় থাকা। সেখানে মোদীর হাতে রাজ্যের দাবিদাওয়া সম্বলিত সাত পাতার চিঠি তুলে দেন মমতা। সেই ইউপিএ আমল থেকে এই সব দাবি জানিয়ে আসছেন তিনি। রাস্তায় নেমে জেহাদ পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন। এ দিন কিন্তু তাঁর সুর সংযতই ছিল। এবং উল্টো দিকে মোদীও মন দিয়ে মমতার কথা শুনেছেন। যদিও আশ্বাস দেননি কিছু। সৌজন্য রেখেই প্রশংসা করেছেন রাজ্যের কিছু কিছু কাজের।
দু’দিনের সফরে রাজ্যে আসা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ দিন নজরুল মঞ্চেই প্রথম সাক্ষাৎ হয় মুখ্যমন্ত্রীর। অনুষ্ঠানের আধ ঘণ্টা আগেই সেখানে চলে আসেন দু’জনে। গ্রিন রুমে তাঁর জন্য নির্ধারিত ঘরে চলে যান মোদী। আলাদা ঘরে অপেক্ষা করেন মমতা।
কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিংহ, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সরকারি কর্তারা। এর পরের সময়টুকু সহজ সম্পর্কের ছবি দেখল নজরুল মঞ্চ। পাশাপাশি বসে যে ভাবে নিচু গলায় আলাপ করলেন মোদী-মমতা, তাতে কে বলবে যে বছরখানেক আগেই ভোটের ময়দানে পরস্পরকে তীব্র আক্রমণ করেছেন তাঁরা! মোদীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে জেলে ভরার হুমকি দিয়েছেন মমতা। এমনকী, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ৯ মাস তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করতে যাননি। আজ অবধি যোগ দেননি প্রধানমন্ত্রীর ডাকা কোনও বৈঠকে।
মোদী-মমতা সৌজন্য আলাপের বিবরণ দিতে গিয়ে নবান্নের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, নজরুল মঞ্চ দেখে বেশ পছন্দ হয় মোদীর। সে কথা তিনি জানান মমতাকে। মমতা তাঁকে বলেন, বাম আমলে এই মঞ্চের বেহাল দশা ছিল। তাঁর সরকার এটিকে নতুন করে সাজিয়েছে। ‘ধনধান্যে’ নামে আরও একটি মঞ্চ যে তাঁরা গড়ছেন, সে কথাও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠান চলাকালীন নিজের অভ্যাসমতো কাগজে ছবি আঁকছিলেন মমতা। উঁকি মেরে এক ঝলক দেখে নেন মোদী।
আসানসোলে ভোটের সময় তৃণমূল যাঁকে হেনস্থা করেছিল বলে অভিযোগ, সেই বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়ও এ দিন মঞ্চে ছিলেন মমতার পাশেই। তাঁর সঙ্গেও একাধিক বার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। বাবুলের গানের সময় তালে তালে মাথাও দোলালেন তিনি। অন্য দিকে, সভার শেষ পর্বে তিন জন উপভোক্তার হাতে বিমা ও পেনশন প্রকল্পের কাগজপত্র তুলে দেওয়ার সময় ফিরহাদ হাকিমের পিঠে আলতো চাপড় মেরে সামনের দিকে ডেকে নিলেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু এই সৌজন্যের পাশেই সরকারের দায়বদ্ধতার প্রশ্নে মোদীকে বিঁধেছেন মমতা। বক্তৃতা দিতে উঠে তাঁর কটাক্ষ, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচিতে কেন্দ্র যেখানে মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পে রাজ্যের বরাদ্দ সেখানে ১০০০ কোটি টাকা।
নিজের বক্তৃতায় মমতার অনুযোগের জবাব দিতে কসুর করেননি মোদী। স্পষ্টই বুঝিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকারের দিকে আঙুল তুললেও আসল দায় তাঁর নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় নির্মাণ শিল্পে এই রাজ্য এক নম্বরে ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণেই ক্রমশ তারা পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। রাজ্য চাইলে সেই দুর্দশা কাটানোর কাজে তিনিই যে সহায় হতে পারেন, বুঝিয়ে দেন মোদী। ৬০ বছরের অবিচারের প্রসঙ্গ তুলে মমতাকে মোদীর বার্তা, ‘‘এর বিরুদ্ধে যে আওয়াজ উনি (মমতা) তুলেছেন, আমিও তাতে সঙ্গ দিতে চাই।’’ মমতাও অবশ্য তার আগেই বলেছেন, ‘‘কেন্দ্র ও রাজ্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে সাধারণ মানুষেরই ভাল।’’
কিছু দিন আগেই সংসদে দাঁড়িয়ে মোদী বলেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধি নিয়ে যেন সন্দেহ প্রকাশ না করা হয়। অনেকের মতে, এ দিনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। গরিব ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে ইদানীং কেন্দ্রীয় সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে কংগ্রেস। জমি বিল থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট বিল— মোদী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে তারা। এই অবস্থায় পাল্টা প্রচারে নামতে দলকে নির্দেশ দিয়েছেন মোদী। এ দিন গরিবদের জন্য তিনটি প্রকল্পের সূচনা সেই প্রচারকেই হাতিয়ার দিয়ে গেল বলে দাবি বিজেপি নেতাদের।
জনধন প্রকল্প থেকে শুরু করে এ দিনের তিনটি প্রকল্প কী ভাবে গরিব মানুষের কাজে লাগবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি গরিবরা সাহায্য নয়, শক্তি চায়। দারিদ্র থেকে মুক্তি পাওয়ার শক্তি।’’ এই প্রসঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা।’ অটল পেনশন প্রকল্পের কথা বলতে গিয়ে মোদীর দাবি, এর সঙ্গে ভোটের রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, এখন যাঁরা এই প্রকল্পে যোগ দেবেন, তাঁরা সুবিধা পাবেন ৬০ বছর বয়স হলে। ‘‘তখন হয়তো কারও মনে হবে মোদীজি এই কাজ করেছিলেন। আর মনে পড়বে কলকাতার কথা। যেখান থেকে এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল।’’
যদিও কংগ্রেসের দাবি, নতুন কোনও প্রকল্প চালু করেননি মোদী। রাজ্যের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, তিনটি প্রকল্পই অন্য নামে চালু ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েতেই ব্যাঙ্কের শাখা খোলার সিদ্ধান্ত ইউপিএ সরকারের আমলেই হয়েছিল। এ জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মুখমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানালেই হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রের কাছে যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy