Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Municipality Recruitment Scam

‘কোড’ নামের আড়ালে পুর নিয়োগ দুর্নীতি! নাম উদ্ধার হতে ফিরহাদ, রথীনের পর ইডি-নজরে আরও এক মন্ত্রী

পুর নিয়োগ মামলায় উদ্ধার-হওয়া নথির পাতায় পাতায় একাধিক ইংরেজি অক্ষর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আধিকারিকদের নজর টানে। সেই সব সাঙ্কেতিক অক্ষরের রহস্যভেদ করেছে ইডি।

Minister’s name found after decoding coded names from seized documents from Ayan Sil in municipality recruitment scam.

(বাঁ দিকে) ফিরহাদ হাকিম, রথীন ঘোষ (ডান দিকে)। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:০১
Share: Save:

কোনও পাতায় লেখা ‘সিএইচ’, কোথাও ‘ডিআই’। পুর নিয়োগ মামলায় উদ্ধার-হওয়া নথির পাতায় পাতায় এমনই একাধিক ইংরেজি অক্ষর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আধিকারিকদের নজর টানে। সেই সব সাঙ্কেতিক অক্ষরের রহস্যভেদ করেছে ইডি। একাধিক ‘কোড’ শব্দ ‘ডিকোড’ করতেই রাজ্যের এক মন্ত্রীর নাম ইডির হাতে এসেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের খবর। এ ছাড়াও সাঙ্কেতিক শব্দের আড়ালে এক প্রাক্তন মন্ত্রীর নামও লুকিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এক পদস্থ আধিকারিক। বর্তমান এবং প্রাক্তন দুই মন্ত্রীই আপাতত তদন্তকারীদের নজরে।

নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে রাজ্যের একাধিক পুরসভার বিভিন্ন পদে ঘুরপথে নিয়োগের জন্য বিভিন্ন স্তর থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল বলে জানতে পারে ইডি। নথি অনুযায়ী, এক মন্ত্রী নিজেই পুরসভায় নিয়োগের জন্য একাধিক প্রার্থীর হয়ে সুপারিশ করেছিলেন। ওই মামলায় এক অভিযুক্তকে জেরা করে তাঁর বয়ান থেকে ওই বিষয়টি জানা গিয়েছে বলেও দাবি ওই সূত্রের। তবে শুধু বয়ানের উপর নির্ভর করে থাকাই নয়, এ সম্পর্কে তাঁরা আরও তথ্য জোগাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্র ধরে প্রমোটার অয়ন শীলের নাম প্রকাশ্যে আসে। ঘটনার সূত্রপাত গত মার্চ মাসের ১৯ তারিখ। সল্টলেকে অয়নের অফিস এবং হুগলিতে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। সেই সময় দিস্তা দিস্তা ওএমআর শিটের পাশাপাশি ২৮ পাতার একটি নথি পান তদন্তকারীরা। আপাতদৃষ্টিতে তা প্রাথমিকে নিয়োগ সংক্রান্ত নথি মনে করা হলেও পরে দেখা যায় ওই নথির মধ্যে রয়েছে একাধিক পুরসভার প্রার্থী তালিকা এবং সেই সংক্রান্ত সুপারিশ। বাজেয়াপ্ত সেই নথির মধ্যে প্রার্থী তালিকায় থাকা নামের পাশে বেশ কিছু ‘কোর্ড ওয়ার্ড’ পান তদন্তকারী আধিকারিকেরা।

ইডি সূত্রের খবর, ‘সিএইচ’, ‘ডিআই’, ‘এসবি’, ‘এমএম’, ‘এ’ ইত্যাদি একাধিক ‘কোড ওয়ার্ড’ লেখা ছিল ওই নথিতে। তার রহস্যভেদে নেমেই ইডির তদন্তকারীরা রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী ও এক বর্তমান মন্ত্রীর নাম জানতে পারেন। রাজ্যের সেই প্রাক্তন মন্ত্রীর বাড়িতে ইতিমধ্যেই পুরসভা নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই। ইডি সূত্রের খবর, ‘কোড’ রহস্য ভেদের পরেই রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু হয়। ইতিমধ্যেই তাঁরা ওই মন্ত্রীর এক ‘ঘনিষ্ঠ’কে জিজ্ঞাসাবাদ করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন।

বাজেয়াপ্ত ২৮ পাতার নথির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পুরসভার নিয়োগের সংক্রান্ত প্যানেলের প্রার্থীর তথ্যাবলি। উত্তর দমদম, নিউ ব্যারাকপুর, দক্ষিণ দমদম-সহ বেশ কয়েকটি পুরসভার প্যানেলের তথ্যও রয়েছে ইডির হেফাজতে-থাকা ওই নথিতে। পুরসভাগুলিতে মেডিক্যাল অফিসার, মজদুর, ওয়ার্ড মাস্টার, ক্লার্ক, অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার, হেল্পার, ড্রাইভার-সহ একাধিক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশের তালিকাও ওই নথিতে রয়েছে।

সেই সুপারিশ কে বা কারা করেছেন, সেই তথ্য জানতে গিয়েই ‘কোড’ নামের রহস্যভেদ হয়েছে বলে ইডির দাবি। তদন্তকারীদের আরও দাবি, সাঙ্কেতিক নামের আড়ালেই ছিল সুপারিশকর্তার নাম। সেখানে যেমন মন্ত্রীর নাম রয়েছে, তেমনই সাঙ্কেতিক শব্দে কোথাও ‘অয়নের’ নাম রয়েছে। কোনও ‘কোড’-এর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ‘চেয়ারম্যান’ শব্দটি। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান বলতে সংশ্লিষ্ট পুরসভার চেয়ারম্যানকে বোঝানো হয়েছে বলেই তদন্তকারীদের দাবি।

ইডির জেরায় অয়ন জানিয়েছেন, পুর নিয়োগে দুর্নীতি ২০১৪-’১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে কমবেশি ৬০টি পুরসভায় কর্মী নিয়োগের কাজের বরাত অয়নের সংস্থা ‘এবিএস ইনফোজ়োন’ পেয়েছিল বলে ইডি আধিকারিকদের জানিয়েছেন অয়ন। সেই সময় এক একটি পুরসভায় প্রায় ১০০ জন করে নিয়োগ করা হয়েছিল। তদন্তকারী সংস্থা মনে করছে, সেই হিসাবে ৬,০০০ নিয়োগ হয়েছিল অয়নের সংস্থার মাধ্যমে। তার মধ্যে প্রায় ৫,০০০ নিয়োগের ফলাফল ‘বিকৃত’ করা হয়েছিল বলেও মনে করছেন ইডি কর্তারা। এর মধ্যে মন্ত্রীর মাধ্যমে কত সুপারিশ করা হয়েছিল, আপাতত তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। একই সঙ্গে ওই সময়কালে মন্ত্রী, বিধায়করা কে কোন পদে ছিলেন, সে সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করা হয়েছে।

কেঁচো খুঁড়তে কেউটের মতোই প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে পুর নিয়োগ দুর্নীতির সন্ধান পায় ইডি। পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে একযোগে ময়দানে নেমেছে ইডি এবং সিবিআই। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় দুই তদন্তকারী সংস্থা রাজ্যের দুই মন্ত্রীর বাড়িতে হানা দিয়েছে। ইডি হানা দেয় খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের বাড়ি। সিবিআই তল্লাশি চালায় পুর ও নগরন্নোয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়ি। সাঙ্কেতিক শব্দ উদ্ধারের পর আরও এক মন্ত্রী ইডির আতশকাচের তলায় চলে এসেছেন বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর।

উদ্ধার-হওয়া নথিতে যে সব পুরসভার নাম পাওয়া গিয়েছে, সেই সব পুরসভার নিয়োগ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। একাধিক পুরসভা থেকে নথিও চেয়ে পাঠিয়েছেন তাঁরা। ওই তদন্তে নেমে ইতিমধ্যে জুন মাসে সিবিআই দমদম পুরসভা, কামারহাটি, টিটাগড়, শান্তিপুর, নিউ ব্যারাকপুর, পানিহাটি-সহ সল্টলেক পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে হানা দেয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে একাধিক ফাইল ইদ্ধার করেন সিবিআই আধিকারিকেরা। ওই সময়ে বিভিন্ন আধিকারিক থেকে ক্লার্কের বাড়িতেও তদন্তে যান গোয়েন্দারা। সেই সময় পুরো বিষয়টিতে ‘রাজনীতির গন্ধ’ পেয়েছিলেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ। অক্টোবরে ফিরহাদের চেতলার বাড়িতে প্রায় ১০ঘন্টা ধরে তল্লাশি চালান সিবিআই আধিকারিকেরা। সেই তল্লাশি নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ফিরহাদ। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘আমি কি চোর?’’

সিবিআইয়ের পাশাপাশি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে উত্তর ২৪ পরগনার মাইকেলনগরে খাদ্যমন্ত্রী রথীনের বাড়িতে তল্লাশি চালান ইডি আধিকারিকরা। মাঝরাতে ইডির অভিযান শেষ হওয়ার পর ওই তল্লাশিকে সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে বর্ণনা করেন রথীন। তাঁকে হেনস্থা করতেই ইডি আধিকারিকেরা তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন এবং নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও নথি তাঁর বাড়ি থেকে পাওয়া যায়নি বলেও দাবি করেন খাদ্যমন্ত্রী। রথীনের বাড়ি ছাড়াও মধ্যমগ্রাম পুরসভার দফতরে হানা দেন ইডির আধিকারিকেরা। দীর্ঘ দিন ওই পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন রথীন। এ ছাড়াও ১০ থেকে ১২টি দলে ভাগ হয়ে বরাহনগর, সল্টলেক-সহ মোট ১২টি জায়গায় ইডি তল্লাশি অভিযান চালায়।

ইডি এবং সিবিআই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রীর বাড়ি তল্লাশি করলেও ফিরহাদ বা রথীন কাউকে তদন্তকারী সংস্থার দফতরে যেতে দেখা যায়নি। তবে ইডি দফতরে একাধিক বার তলব করা হয় টিটাগড় পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রশান্ত চৌধুরী, বরাহনগর পুরসভার চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিক এবং কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহাকে। ইডি প্রশান্তর ফোন বাজেয়াপ্ত করে ফোনে থাকা তথ্য সংগ্রহ করেছে। দফায় দফায় প্রশান্ত, অপর্ণা এবং গোপালকে তদন্তকারী সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তবে এখনও পর্যন্ত পুর নিয়োগ মামলায় ইডি বা সিবিআই কাউকে গ্রেফতার করেনি। ইডির এক কর্তার বক্তব্য, ‘কোড’-এর রহস্যভেদ হলেও দুর্নীতির রহস্যভেদ করতে আরও শক্ত করে আটঘাট বাঁধছেন তাঁরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE