সঙ্কটে ঐক্যের ডাক!
কাল, রবিবার মেদিনীপুর শহরে জেলা সিপিএমের এক বৈঠক রয়েছে। দলের এক সূত্রে খবর, বৈঠকে শুধুমাত্র জোনাল কমিটির সদস্যরাই উপস্থিত থাকবেন। লোকসভা ভোটে নজিরবিহীন ভরাডুবির পর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনা নিয়ে এখানে আলোচনা হবে। সভার মূল বক্তা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। উপস্থিত থাকবেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারও। তিনিই ওই সভার আহ্বায়ক। বস্তুত, পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের কোনও সভায় শেষ কবে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সূর্যকান্তবাবু, তা মনে করতে পারছেন না সিপিএমের প্রবীণ নেতারাও। তাহলে কী এই দুই নেতার ‘দূরত্ব’ ঘুচতে শুরু করেছে? জোর জল্পনা দলের অন্দরেই।
জেলা সিপিএমে বিভাজন নতুন নয়। একদিকে দীপক সরকারের অনুগামীরা। অন্য দিকে, সূর্যকান্ত মিশ্রের অনুগামীরা। অবশ্য সিপিএম নেতৃত্ব এই বিভাজনের কথা মানতে নারাজ। গত বিধানসভা ভোটের আগেও জেলায় দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সূর্যকান্তবাবুকে বিশেষ দেখা যেত না। মাঝে-মধ্যে তিনি নিজের বিধানসভা কেন্দ্র নারায়ণগড়ে আসতেন। বিধানসভা ভোটের পরও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। দলের এক সূত্রে খবর, এক সময় এই দুই নেতার সম্পর্ক ভালই ছিল। তখন সূর্যকান্তবাবু ছিলেন মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি। দীপকবাবু ছিলেন মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান। পরে ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়। সূর্যবাবু মন্ত্রী হয়ে রাজ্যে চলে যাওয়ার পরই দলীয় সংগঠনের রাশ নিজের হাতে নেন দীপকবাবু। বিভাজন আরও বাড়ে ২০০৪ সালের জেলা সম্মেলনের পর। ওই সম্মেলনে জেলা সম্পাদকের পদ থেকে দীপকবাবুকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সূর্য-অনুগামীরা। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য পাশে থাকায় দীপকবাবুই দলের জেলা সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। এরপর জেলায় সূর্য-অনুগামী বলে পরিচিতদের ডানা ছাঁটা শুরু হয়। এর মধ্যে কংসাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের কোনও সভায় রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়ায় সিপিএমের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়েছে।
বিপর্যয়ের ধাক্কাই কী দুই নেতার মধ্যে সেতু তৈরি করছে? রবিবার জেলা সিপিএমের সভায় কী নিয়ে আলোচনা হবে? দলের নীচুতলায় এ নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপকবাবু বলেন, “এটা আমাদের সাংগঠনিক সভা। সাংগঠনিক কিছু দিক নিয়েই আলোচনা হবে। লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর্যালোচনাও হবে।” সভার মূল বক্তা সূর্যকান্ত মিশ্র? দীপকবাবুর জবাব, “কেন? দলের পলিটব্যুরো সদস্য দলের সভায় থাকতে পারেন না?” দলের এক সূত্রের দাবি, ঐক্যের বীজ বোনা শুরু হয়েছে মাস কয়েক আগে থেকেই। গত লোকসভা ভোটের প্রচারেও দু’দফায় জেলায় এসেছেন সূর্যবাবু। দীপক-অনুগামী বলে পরিচিত নেতারা তাঁকে প্রচারে আনতে চেয়েছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে মেদিনীপুরে দলের এক প্রকাশ্য জনসভায় নেতাই কাণ্ড নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের করা মন্তব্য ঘিরে রাজ্য-রাজনীতিতে কম জলঘোলা হয়নি। বস্তুত, এই ইস্যুতে বুদ্ধবাবুর পাশে দাঁড়ায়নি আলিমুদ্দিনও। দলের এক বৈঠকে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু জানিয়ে দেন, নেতাই নিয়ে এই মন্তব্য না-করলেই ভাল হত। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিভাজন সরিয়ে রেখে এ ক্ষেত্রে জেলা সিপিএমের পাশে এসেই দাঁড়ান সূর্যবাবু। নতুন করে কোনও বিতর্ক না উস্কে দিয়ে তিনি জানান, নেতাই বিচারাধীন বিষয়। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেন না।
দলের এক সূত্রের দাবি, এরপর থেকেই জেলা সিপিএমের বিভাজনের ছবিটা বদলাতে শুরু করে। দীপক এবং সূর্য-অনুগামীরা কিছুটা হলেও কাছাকাছি আসা শুরু করেন। গত বিধানসভা ভোটের পরও রাজনৈতিক প্রস্তাব, রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক রিপোর্ট এবং মতাদর্শগত দলিল নিয়ে মেদিনীপুর শহরে জেলা সিপিএমের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। গত লোকসভা ভোটের আগেও শহরে এসে দলের বৈঠক করেছেন বিমানবাবু। এ বার সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা সভার প্রধান বক্তা সূর্যকান্ত মিশ্র।
একদা ‘লালদুর্গ’ বলে পরিচিত পশ্চিম মেদিনীপুরেও গত লোকসভা ভোটে নজিরবিহীন ভরাডুবি হয়েছে সিপিএমের। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে এ জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েতে তা কমে হয় ৩৪ শতাংশ। আর লোকসভা ভোটে তা আরও কমে হয়েছে ২৯ শতাংশ। যেখানে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৫১ শতাংশ। সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, যে সংখ্যক বুথে অবাধ ভোট হয়েছে, সেখানে বামেরা ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই বিপর্যয়ের ধাক্কার মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ শুরু করেছে সিপিএম। সংগঠনে ঝাঁকুনি দেওয়ারও চেষ্টা চলছে। জেলা সিপিএমের এক নেতার মন্তব্য, “এটা ঠিক, এই কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করার অভিজ্ঞতা দলের বেশির ভাগেরই নেই। উপরতলায় বিভাজন এড়ানো গেলে দলের নীচুতলা আরও উদ্দীপ্ত হবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy