প্রতীকী ছবি।
করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে শিশুশ্রমিক স্কুলও। দেখা দিয়েছে সঙ্কট। পড়ুয়াদের একাংশ ফের শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়ছে। কেউ চাষের কাজে মাঠে যাচ্ছে। কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে যাচ্ছে দিনমজুরির। দিনমজুরির কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছেন শিক্ষকদের একাংশও! তাঁদের ভাতাও যে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বন্ধ।
‘স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন অফ ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার অ্যাসোসিয়েশনে’র পশ্চিম মেদিনীপুর-ঝাড়গ্রাম শাখার সম্পাদক গোপালচন্দ্র বসু বলছেন, ‘‘১৫ মাস ধরে ভাতা বন্ধ। ভাতা না পেয়ে আতান্তরে পড়েছেন শিক্ষকদের সকলেই। সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। দিনমজুরির কাজও করছেন।’’ তিনি মানছেন, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের একাংশ ফের কাজে চলে যাচ্ছে। অবিলম্বে শিশুশ্রমিক স্কুলগুলি খোলা দরকার। শিশুশ্রমিক স্কুলের পড়ুয়াদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণও দেওয়া হত। করোনা কালে সেই প্রশিক্ষণও বন্ধ রয়েছে।’’ পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম দুই জেলার ৪২টি শিশুশ্রমিক স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ২,১০০। শিক্ষক রয়েছেন ১৬০ জন। সেই ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে শিশুশ্রমিক স্কুলগুলিও বন্ধ রয়েছে। ৪২টি স্কুলের মধ্যে ঝাড়গ্রামে রয়েছে ৭টি। পশ্চিম মেদিনীপুরে ৩৫টি। পশ্চিম মেদিনীপুরের ৩৫টির মধ্যে মেদিনীপুর মহকুমায় রয়েছে ৭টি, ঘাটালে ১৭টি, খড়্গপুরে ১১টি। শিশুশ্রম ছেড়ে আসা ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সীরা এই স্কুলগুলিতে পড়ে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিশুশ্রমিক স্কুলে পড়ানো হয়। পরে পড়ুয়াদের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
এই স্কুল চলে কেন্দ্রীয় অনুদানেই। প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা পাওয়ার কথা পড়ুয়াদের। ওই অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ভাতা বাবদ বরাদ্দ বন্ধ। এক সময়ে ১০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হত। পরে বেড়ে হয়েছিল ১৫০ টাকা। ২০১৭ সাল থেকে ভাতা বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা। দীর্ঘ সময় মাসিক ভাতা পায়নি পড়ুয়ারা। শিক্ষকেরাও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ভাতা পাননি। শিক্ষকেরা মাসে ৭ হাজার টাকা করে ভাতা পান। ভাতার অর্থ দেয় কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকই। গোপালচন্দ্র বলছেন, ‘‘১৫ মাসের ভাতা বকেয়া রয়েছে।’’ এই সময়ের মধ্যে অবশ্য মিড ডে মিলের খাদ্য সামগ্রী পাচ্ছে পড়ুয়ারা। পড়ুয়াপিছু দেওয়া হয় ২ কিলো চাল, ২ কিলো আলু, ১ কেজি ছোলা, ২৫০ গ্রাম মুসুর ডাল, ২৫০ গ্রাম চিনি, ১০০ গ্রাম সয়াবিন, ১টি সাবান। যে মাসে যেমন বরাদ্দ হয়, সে মাসে তেমন বিলি হয়। গোপালচন্দ্র বলছেন, ‘‘পড়ুয়ারা আসে না। তবে প্রতি মাসে স্কুলগুলির অফিস ১৫-২০ দিন করে খোলা থাকে। শিক্ষকেরা আসেন। শুধু তো খাদ্য সামগ্রী বিলি নয়, ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যের খোঁজখবরও যে রাখতে হয়।’’ বেশিরভাগ শিশুশ্রমিক স্কুলই চলে ভাড়া বাড়িতে।
ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড়ের নেতাইয়ের শিশুশ্রমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সঞ্চারী মণ্ডল বলছে, ‘‘স্কুল খোলা থাকলে পড়াশোনাটা ঠিকমতো করতে পারতাম।’’ ওই স্কুলের শিক্ষক দিলীপ ভুঁইয়া বলছেন, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের একাংশ মাঠে আলু লাগাতে যাচ্ছে। কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে দিনমজুরির কাজে চলে যাচ্ছে।’’ গড়বেতার আমলাগোড়ায় শিশুশ্রমিক স্কুলও যথারীতি বন্ধ। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারা ভুলতে বসেছে প্রাথমিকের পাঠ। অভিভাবকেরা মানছেন, ‘‘স্কুল খুললে নতুন করে সব শেখাতে হবে ছেলেমেয়েদের।’’ স্কুলের আসবাবপত্রও নষ্ট হতে বসেছে। ঘাটালের একটি স্কুলের এক পড়ুয়া বলছিল, ‘‘মিড ডে মিলের খাদ্যসামগ্রী এলে বাড়ির কেউ গিয়ে নিয়ে আসে। আমি ঠোঙা তৈরির কাজ শিখতাম। এখন ভুলে গিয়েছি।’’ দাঁতনের এক শিক্ষক বলছেন, ‘‘ভাতা বন্ধ। অর্থকষ্টে ভুগছি। শরীর অসুস্থ। মেদিনীপুরে গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কেনার মতোও সামর্থ্য নেই।’’
ওই অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, তারা কয়েকবার জেলা প্রশাসনের কাছে বকেয়া ভাতা মেটানোর দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে। দুরবস্থার কথা জানিয়ে সমাধান চেয়েছে। এই প্রকল্পের পশ্চিম মেদিনীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা আধিকারিক অচিন্ত্য সিংহ বলেন, ‘‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে।’’ জেলা প্রশাসনের অন্য এক আধিকারিক বলেন, ‘‘শিশুশ্রমিক স্কুলে শিক্ষকদের ভাতার অর্থ দেয় কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। সমস্যার কথা জানা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো আমাদের কার্যত কিছু করারই নেই। স্মারকলিপির প্রতিলিপি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
তথ্য সহায়তা: বরুণ দে, কিংশুক গুপ্ত, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, অভিজিৎ চক্রবর্তী (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy