পূর্ব বর্ধমানের কালনা ব্লকের মধুপুরে ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় রবিনকে অভ্যর্থনা।
সমাজ না রাজনীতি। নাকি সমাজ এবং রাজনীতি। লোকসভা ভোট মিটতেই বহুদিনের দ্বন্দ্বের একটা আপাত সমাধানসূত্র বার করল সাঁওতালি সামাজিক সংগঠন। সমাধানটা অনেকটা এ রকম— সমাজ এবং রাজনীতি। তবে সমাজের সময় সমাজ। রাজনীতির সময় রাজনীতি। এক ব্যক্তির দ্বৈত সত্তা স্বীকার করা হল। তবে সঙ্গে শর্ত— ব্যক্তিকে দ্বৈত সত্তার মধ্যে প্রাচীর গড়তে হবে। রাজনীতির সময় সামাজিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক পরিচিতি কাজে লাগানো যাবে না। সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নেওয়ার রীতি ছিল আগে। সে দিক থেকে দেখলে এই পরিবর্তন কার্যত বৈপ্লবিক। যার নেপথ্যে রয়েছেন রবিন টুডু।
নিত্যানন্দ হেমব্রম প্রতিষ্ঠিত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সামাজিক সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলে’র নতুন ‘দিশম পারগানা’ হয়েছেন রবিন। তিনি দিশম পারগানা হতেই আদিবাসী সামাজিক সংগঠনভুক্তদের রাজনীতি করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আদিবাসী সামাজিক সংগঠনটি। রবিন দিশম পারগানা হওয়ার পর সাঁওতাল সমাজের প্রচলিত আইনটির (Santali customary Law) সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিও উঠেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের কাছে দাবি জানাতে চলেছে পারগানা মহল।
গত বছর ১১ জুলাই প্রয়াত হন সংগঠনের দিশম পারগানা (সর্বভারতীয় প্রধান) নিত্যানন্দ হেমব্রম। নিত্যানন্দের প্রয়াণে সামাজিক সংগঠনের সর্বোচ্চ পদটি ফাঁকা ছিল। রবিন রাজ্যের প্রধান ‘পনত পারগানা’ পদে আছেন। এখন থেকে তিনি দিশম পারগানার পাশাপাশি, পনত পারগানার দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। জানা গিয়েছে, দিশম পারগানা বেছে নেওয়ার জন্য গত ১৫ ও ১৬ জুন পূর্ব বর্ধমানের কালনা ব্লকের মধুপুর কমিউনিটি হলে দু’দিনের বৈঠক ডেকেছিলেন সংগঠনের দিশম পারানিক চন্দ্রমোহন মান্ডি। সাংগঠনিক আলোচনার পর ১৬ জুন ‘দিশম পারগানা’ পদে অভিষিক্ত হন রবিন। এই প্রথমবার সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বও যে কোনও রাজনীতি করতে পারেন। তবে রাজনীতির মঞ্চে সামাজিক পদ ব্যবহার করা যাবে না। পাশাপাশি, সামাজিক কর্মসূচিতেও সংশ্লিষ্ট পদাধিকারীর রাজনৈতিক পদের উল্লেখ অথবা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আনা যাবে না।
দ্বৈত সত্তার স্বীকৃতি নিয়ে বিরোধ বেধেছে বারবার। একটা সময় ছিল যখন রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি রবিনকে। কার্যত কোণঠাসাও হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন রবিন। সাঁওতালদের সর্বোচ্চ সংগঠনের শীর্ষপদে বসলেন। গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরিবর্তন করলেন। রবিন বলেন, ‘‘মানুষ যেমন সামাজিক জীব। তেমনই মানুষের জীবন আবর্তিত হয় রাজনীতিকে ঘিরে। আমার দু’টো সত্তা। কিন্তু দু’টি সত্তার মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। আমাদের দেশে রাজনীতি করা যেমন সাংবিধানিক অধিকার। তেমনই সামাজিক সংগঠন করারও সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে।’’
প্রশ্ন হল, সাঁওতালদের তো আরও সংগঠন রয়েছে। সংগঠনে রবিনদের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীও রয়েছে। তা হলে বিরুদ্ধতার স্বর চাপা পড়ে থাকবে কোন অঙ্কে? রবিন বরাবরই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ। লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের প্রভাব বেড়েছে। দিল্লির রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে তৃণমূল। দিশম পারগানা হয়ে রবিন ‘সান্তালি কাস্টমারি ল’কে সংবিধান স্বীকৃত করার জন্য আন্দোলনের পথে যাচ্ছেন বলে সূত্রের খবর। ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করে কেন্দ্রের মিলিজুলি সরকারের উপর চাপ বাড়ানোর কৌশলের পথেই কি হাঁটতে চলেছেন রবিন? তিনি অবশ্য বলছেন, ‘‘আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অতি সুপ্রাচীন। গ্রামস্তরে মাঝির নেতৃত্বে পাঁচজন এবং অঞ্চল, ব্লক, মহকুমা, জেলা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয়স্তরের প্রতিটিতে পারগানার নেতৃত্বে পাঁচজন করে প্রধান কর্মকর্তা থাকেন। তাঁদের নেতৃত্বেই সমাজ পরিচালিত হয়।’’ রবিন জানান, সাঁওতালদের নিজস্ব সামাজিক প্রচলিত আইন রয়েছে। যদিও সেটি দেশের সংবিধান স্বীকৃত নয়। তবে কয়েক দশক আগেও এই আইনের মাধ্যমেই সাঁওতাল সমাজের নানা সমস্যা মেটানো হত। সামাজিক প্রধানরাই নানা নালিশের বিচার করতেন। এখনও ফৌজদারি বাদে বেশিরভাগ দেওয়ানি সমস্যা সাঁওতালি প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই মিটিয়ে ফেলা হয়। প্রসঙ্গত, সান্তালি কাস্টমারি ল নিয়ে নিত্যানন্দ হেমব্রমের লেখা একটি ইংরেজি বইও রয়েছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই আইন। রবিন বলছেন, ‘‘সাঁওতালি সামাজিক প্রচলিত আইনটির সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য রাজ্য সরকারের মাধ্যমে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।’’
সূত্রের খবর, ওই দাবি নিয়ে জঙ্গলমহলে জোরদার আন্দোলনের পথে যাচ্ছে রবিনের নেতৃত্বাধীন পারগানা মহল! রাজনীতি করার অধিকার আনলেন। সেই জোরেই সম্প্রদায়ের সম্ভবত সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয় (সান্তালি কাস্টমারি ল)নিয়ে আন্দোলনের পথে গেলেন।
রবিন কি তবে সাঁওতালি সমাজের রবি হয়ে উঠছেন? →(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy