সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে সংসারে অশান্তির মূলে যে মদ, সেটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন নমিতা সিংহ, দুর্গা নায়েকরা। তাই চোলাই ঠেকাতে আন্দোলনে নেমেছিলেন তাঁরা। এক সময়ে মেদিনীপুর-ঝাড়গ্রাম (ভায়া ধেড়ুয়া) সড়ক অবরোধ করেছিলেন। এমনকী, মেদিনীপুর গ্রামীণের মণিদহের এই বাসিন্দারা স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। অবরোধ-বিক্ষোভের পরে এলাকায় ছুটে গিয়েছিল পুলিশ-প্রশাসন। আবগারি কর্মীরাও। ভাঙা হয়েছিল চোলাইয়ের ঠেক।
স্থানীয় এক মহিলার কথায়, ‘‘ঘরের ছেলেরা চোলাই খাবে। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকবে। ঘরে ফিরে বউ-মেয়েকে পেটাবে। এটাই যেন রোজকার ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমরা নিজেরাও চোলাইয়ের ঠেক ভেঙেছি।’’ শুধু মণিদহ নয়, জেলার অজস্র জায়গায় ছোট-বড় গাছের নীচে উনুন জ্বালিয়ে তৈরি হয় চোলাই। প্রশাসনের এক সূত্রও মানছে, গত আট মাসে প্রচুর চোলাই ও চোলাই তৈরির উপকরণও উদ্ধার হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে নভেম্বরে ৫,৯০৯ কিলোগ্রাম গুড়, ৪,৩৮২ কিলোগ্রাম মহুয়া, ৭৮৪ কিলোগ্রাম বাখার, ২২৪ লিটার উদ্ধার হয়েছে। আটক হয়েছে ১৫৫টি ভ্যান, ৬৩টি বাইক, ৫টি গাড়ি। জেলাশাসক পি মোহনগাঁধী বলেন, ‘‘আরও অভিযানের ব্যাপারে পরিকল্পনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ জেলার আবগারি সুপারিন্টেনডেন্ট একলব্য চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘অভিযান চলছে। গত কয়েকদিনেও অনেক ভাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।’’
একাংশ আবগারি কর্মীর ব্যাখ্যা, চোলাই তুলনায় সস্তা। তাই অনেকে চোলাই ছাড়তে চায় না। আবগারি দফতরের এক সূত্রে খবর, দেশি মদের দাম যেখানে ৭৫ টাকা (৬০০ মিলিলিটার), সেখানে একই পরিমাণ চোলাইয়ের দাম ১৫ টাকা। কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, অভিযানে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন, চোলাইয়ে যারা বুঁদ হয়ে থাকে তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক, দিনমজুর। এখন একশো দিনের কাজের মজুরি ১৯১ টাকা। অন্য কাজে শ্রমিকদের মজুরি গড়ে ২২০-২৪০ টাকা। আর দিনমজুরি দিনে গড়ে ১৮০-২০০ টাকা। সব দিনই যে কাজ মেলে তা নয়। এক আবগারি কর্মীর কথায়, ‘‘চোলাইয়ের থেকে দেশি মদের দাম পাঁচগুন বেশি। দিনে গড়ে ১২০-১৩০ টাকা রোজগার করে কে আর ৭৫ টাকা শুধু মদের পিছনেই খরচ করতে চায়? তাই অনেকেই চোলাই খায়! ’’
জেলার অনেক এলাকায় আবার ‘র’ স্পিরিট বা ইথাইল অ্যালকোহলে জল মিশিয়ে চোলাইয়ের বিকল্প তৈরি হয়। চোলাই মূলত তৈরি হয় গুড় থেকে। গুড়ের বিকল্প হিসেবে চালের গুঁড়ো ব্যবহার করা যায়। আশেপাশের এলাকায় চাহিদা মেটানোর পরে চোলাই অন্যত্র পাচারও করা হয়। কিছু জায়গায় দেশি মদের কাঁচামাল তৈরির কারখানাও রয়েছে। অবৈধ ভাবে বহু ছোট দোকান বা ঝুপড়িতে দেশি- বিদেশি মদও বিক্রি হয়। ‘সিল’ কেটে। খুচরো ভাবে। কিছু এলাকায় তাড়িরও রমরমা রয়েছে। খেজুর বা তাল গাছের রস সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, গাছের শিকড় ইত্যাদি মিশিয়ে তাড়ি বানানো হয়। নেশা চড়াতে অনেক সময়ে রাসায়নিক সারও দেওয়া হয়। প্রশাসনের এক সূত্রের দাবি, যারা বিষমদের কারবারে যুক্ত, তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy