আবেগে-হুজুগে: বুধবার মৃত হাতিদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র
ঝুলে থাকা হাইটেনশন লাইনের নীচে শুঁড়ে জড়াজড়ি হয়ে পড়ে রয়েছে দু’টি স্ত্রী হাতির নিথর দেহ। কিছুটা দূরে পড়ে পুরুষ দাঁতাল। তাদের চারপাশে তখন নিজস্বী ও ভিডিয়ো তোলার ধূম। কেউ কেউ তো উৎসাহের চোটে ভিডিয়ো কলই করে বসলেন।
সোমবার লালগড়ের দিক থেকে বিনপুরের কুশবনির জঙ্গলে এসেছিল ২২টি হাতির দল। মঙ্গলবার রাতে ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুরের কাঁকো অঞ্চলের সাতবাঁকি গ্রামের হাইটেনশন তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সেই গ্রামের তিনটি পূর্ণবয়স্ক হাতির মৃত্যু হয়। তারপর তাদের দেহ দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ল ওই গ্রামে। গাড়ি ভাড়া করেও অনেকে নিথর-হাতি দেখতে এলেন। অবস্থা দেখে এক গ্রামবাসী বলেন উঠলেন, ‘‘ভাগ্যিস বেশির ভাগ জমিতে এখনও ধান রোয়ার কাজ শুরু হয়নি। তাই রক্ষে। না হলে ধানের দফারফা হয়ে যেত আজ।’’
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতি মৃত্যুর ঘটনা জঙ্গলমহলে নতুন নয়। প্রতিবারেই হাতির মৃত্যুর পরে তার নিথর দেহকে পুজোর ধূম লাগে। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেলা যত বেড়েছে তত মানুষের ঢল বেড়েছে। কেউ হাতির পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন, কেউ আবার দাঁতালের প্রকাণ্ড দাঁত স্পর্শ করছেন। কেউ স্পর্শ করছেন লেজ। কেউ শুঁড়ের কাছে প্রণামী দিয়ে বলছেন, ‘রক্ষা করো হাতিঠাকুর’। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষ তিনটি হাতিকে সিঁদুর মাখিয়ে, গায়ে ফুল ছড়িয়ে, মাথার কাছে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অনেকেই হাতিঠাকুরকে প্রণাম করলেন।
বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়গ্রামে তিন বছরের ছেলেকে চিকিৎসক দেখাতে যাচ্ছিলেন ডগমণি মুর্মু। হাতির মৃত্যুর খবর জেনে মাঝপথে মোহনপুর বাসস্টপে নেমে ছেলেকে কোলে নিয়ে হাতি ঠাকুরের আশীর্বাদ নিতে মাঠের দিকে ছুটলেন তিনি। ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ার ব্যবসায়ী অজয় মারাণ্ডি জানালেন, গত বছর জামবনির ডুমুরিয়ায় রেলে তিনটি হাতি কাটা পড়া তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। এ দিনও হাতিদের মৃত্যুর খবর শুনে চলে এসেছেন। অজয়ের কথায়, ‘‘হাতি ঠাকুরের লোম সংগ্রহ করে রাখলে পুণ্যলাভ হয়। তাই এসেছি। লোমও সংগ্রহ করেছি।’’ অত্যুৎসাহীদের অনেকেই মৃত হাতির ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন। বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা এলাকার যুবক জিতেন মাহাতো তো মোবাইলে ভিডিও চ্যাট করে বাড়ির লোকজনকে মৃত হাতিদের ছবি দেখাচ্ছিলেন।
সব মিলিয়ে চারপাশে প্রায় মেলার পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। লোকজনের ভিড় দেখে সাতবাঁকির কিছু যুবক পাচ টাকা দামে বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি শুরু করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে চারশো প্যাকেট বিস্কুট বিক্রি হয়ে যায়। তিনটি হাতির অকাল মৃত্যতে কাউকে কাউকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গিয়েছে। যেমন কাঁথির বাসিন্দা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার চম্পক ভট্টাচার্য। বিনপুরের হাড়দা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এভাবে হাতিদের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক।’’ স্থানীয় মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিচার-ইনচার্জ শুভঙ্কর মহাপাত্র, কাঁকো গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মী বোধিসত্ত্ব সরকার বলেন, ‘‘আজ আমাদের সবার মন খুবই খারাপ।’’ ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা পেশায় স্কুল শিক্ষক বিশ্বরূপ মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘নূন্যতম সচেতনতা নেই। হাতির গায়ে উঠেই সেলফি। এটা কবে বন্ধ হবে।’’
কাঁকো গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কৃষ্ণা মান্ডি মুর্মুও অত্যুৎসাহীদের ভিড়ে ছিলেন। কৃষ্ণা দাবি করেন, ‘‘এলাকায় যে হাইটেনশন লাইন ঝুলছে সেটা আমার কাছে কেউ জানাননি। আমি জানলে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাকে জানাতাম।’’ যদিও সাঁতবাকির সুশান্ত মাহাতো, করকরা গ্রামের সুকুমার চৌধুরীদের পাল্টা দাবি, ওই এলাকার জমিতে হাইটেনশন লাইন দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই ঝুলে রয়েছে।
এ দিন বন দফতর হাতির দেহগুলি উদ্ধার করতে এলে গ্রামবাসীদের একাংশ বাধা দেন। তাঁদের দাবি, তিনটি হাতির স্মরণে সৌধ তৈরি করতে হবে। পরে ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আরেক দফা বিক্ষোভ হয়। বন দফতর সৌধ গড়ার আশ্বাস দিয়েছে। ঝাড়গ্রামের ডিএফও বাসবরাজ হলাইচ্চি বলেন, ‘‘এলাকাবাসীর দাবি খতিয়ে দেখা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy