অগ্নি-পাট। জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হাঁটছেন ভক্তারা। নয়াগ্রামের রামেশ্বর শিব মন্দিরে। ছবি:দেবরাজ ঘোষ।
চৈত্র-অবসানের দুপুরে সূর্য তখন মধ্য গগনে। মন্দির লাগোয়া উঠোনে গনগনে কয়লা মাড়িয়ে অবলীলায় এপার-ওপার হচ্ছেন ‘ভক্তা’ গ্রামবাসীরা। আর তাই দেখে তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছেন আবালবৃদ্ধবনিতা।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের রামেশ্বর শিব মন্দিরের গাজন উৎসব কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। গাজন উৎসবের অনুসঙ্গ হিসেবে এখানে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার বহু প্রাচীন এই রীতির নাম ‘অগ্নি-পাট’। চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিতে ভক্তাদের কৃচ্ছ্রসাধনের অন্তিম পর্যায় দেখার জন্য ভিড় করেন মানুষজন। হবেই তো। এ যে সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার মহেন্দ্রক্ষণ।
যাঁদের দেখার জন্য এত উৎসাহ, তাঁরা কিন্তু গ্রামগঞ্জের সাধারণ চাষভুষো। নিতান্তই ছা-পোষা লোক। দৈনন্দিন জীবন-যন্ত্রণার বারোমাস্যার মধ্যেও তাঁরা বর্ষশেষে নিজেদের শরীরকে যন্ত্রণা দিয়ে যেন অলীক সুখের সন্ধান পান! স্থানীয় দেউলবাড় ও বিরিবেড়িয়া গ্রামের নীলকন্ঠ প্রধান, নিরঞ্জন প্রধান, শ্যামল প্রধান, বিশ্বম্ভর দেহুরি, নিতাই প্রধান, শম্ভুনাথ মাঝি, আকুল ভক্তা, খগেন প্রধান, বিদ্যাধর দাস, বৃষকেতু সিংহ, আদিত্য সিংহ, প্রবীর সিংহ ও কুশধ্বজ সিংহদের পরণে পীতবসন। তাঁদের গলায় অজস্র আকন্দ, ধুতরো ও কলকে ফুলের মালা। হাতে বেতের গাছি। নাগাড়ে বেজে চলা ঢোলের তালে ছন্দবদ্ধ ভাবে এই ভক্তারা ক্রমাগত হাঁটতো থাকলেন লালতপ্ত কয়লার উপর দিয়ে।
হলুদ-জলে পা ধুয়ে ‘অগ্নি-পাট’ ক্রিয়া শেষ হতেই ভক্তাদের ধরা ছোঁয়ার জন্য জনতার সে কী আর্তি! শতাব্দী প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নাটমন্দিরের উপর থেকে ভক্তারা গলার আকন্দ ফুলের মালা ছুঁড়ে দেন হরির লুঠের মতো।
‘দেবতার আশীর্বাদী’ সেই মালা পাওয়ার জন্য মানুষজনের মধ্যে দারুণ হুড়োহুড়ি! ভক্তাদের শিরোমণি ‘পাটভক্তা’ বৃদ্ধ নীলকন্ঠ প্রধান বলেন, “সেই যৌবনকাল থেকে প্রতি বছর গাজনের ভক্তা হচ্ছি। বছর শেষের সাতটা দিন আমরা মন্দিরেই থাকি। কঠোর নিয়ম পালন চলে। সারা দিন উপবাসের পর দিনান্তে সামান্য আহার। এ ভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য শরীর ও মনটা তৈরি হয়ে যায়। তখন আর শরীরে কষ্টবোধ হয় না।”
গত বছর প্রথমবার ভক্তা হয়েছিলেন বছর পঁচিশের নিতাই প্রধান। এবারও তিনি কনিষ্ঠতম ভক্তা। নিতাই বলেন, “অগ্নিপাটের সময় এত মানুষের কোলাহলে মনে হয়, আমরা যেন কেউকেটা। আমাদের ঘিরে কত মানুষের প্রত্যাশা!”
রামেশ্বর মন্দির কারচারাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উজ্জ্বলকুমার দত্ত বলেন, “সাতটা দিন কঠোর সংযম পালনের ফলে হয়তো ভক্তাদের শরীরে কিছু প্রতিরোধ তৈরি হয়। যে কারণে আগুনে হাঁটলেও তাঁদের পায়ে ফোস্কা পড়ে না। এবার উৎসব দেখার জন্য বহু পর্যটকও এসেছেন।”
রামেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, আনুমানিক ষোড়শ শতকে নয়াগ্রামের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে রামেশ্বর শিব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। আগাগোড়া ঝামা পাথরের তৈরি এই মন্দিরকে ঘিরে এখন মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে বারোটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের সঠিক ইতিহাস অজ্ঞাত। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের জনশ্রুতি রয়েছে।
যেমন, অখ্যাত রসিকমঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে, বনবাস কালে রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ এই এলাকার তপোবনে ছিলেন। ওই সময় সুবর্ণরেখার বালি দিয়ে নদীর তীরে বারোটি শিবলিঙ্গ গড়ে মহাদেবের পুজো করেছিলেন সীতা। রামচন্দ্রের অনুরোধে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই মন্দির তৈরি করেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, মরাঠা বর্গিরা এই এলাকায় আত্মগোপন করার জন্য শিব মন্দিরটি তৈরি করেছিল। রাত হলেই সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোহিনী ও কুলটিকরি এলাকায় লুঠতরাজ চালাত। স্থানীয় গবেষকদের একাংশ মনে করেন, গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল দাঁতন পর্যন্ত। শশাঙ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত।
গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় রামেশ্বর মন্দির তৈরি হয়েছিল বলেও দাবি করেন স্থানীয় গবেষকদের একাংশ। এক সময় নয়াগ্রামের এই এলাকাটি ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে মনে করেন, ওড়িশার গঙ্গ রাজার আমলে এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। রামেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে গাজন উৎসবটি রীতিমতো কয়েকশতাব্দী প্রাচীন। গাজনের উৎসবটি মূলত মূলবাসীদের উৎসব। নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে সামিল হয়।
নয়াগ্রামের গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “গাজন উৎসবে অনার্য সংস্কৃতির প্রতিফলন হয়েছে। কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ঐশী শক্তিলাভের প্রার্থনায় ভক্তারা নানা ধরনের ক্রিয়াকলাপ করে থাকেন। সুব্রতবাবু জানালেন, জঙ্গলমহলের চোরচিতা এলাকার চোরেশ্বর শিবমন্দির, চন্দ্রির চন্দ্রশেখর শিবমন্দিরের মতো বিভিন্ন শিব মন্দিরে গাজনের উত্সব হয়। নববর্ষের শুরুর আগে এটি জঙ্গলমহলের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ লোকউৎসব।
গাজন উৎসব যেন জঙ্গলমহলের মূল অধিবাসীদের জীবনযন্ত্রণার লড়াইয়ের প্রতীকী উদযাপন! শেষ চৈত্রে তা যেন আরও মূর্ত হয়ে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy