রবি শবরের ঝুপড়ি। বেলপাহাড়ির লাগাদড়িতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বেলপাহাড়ির শাঁখাভাঙা গ্রামের চুনু শবর। সপরিবারে থাকেন পাতার ছাউনি দেওয়া ঝুপড়িতে। ঝেঁপে বৃষ্টি হলে আশ্রয় নিতে হয় অন্যের বাড়ির উঠোনে। কারণ, সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পাননি চুনু। এই ভরা বর্ষায় হতদরিদ্র চুনুর মতোই তিলডাহির রবি শবর কিংবা লবনি গ্রামের বকুল শবরদের কার্যত গাছতলাতেই দিন কাটাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। লোধা-শবরদের সংগঠনের হিসেব বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১৭ হাজার লোধা-শবর পরিবারের মধ্যে তিন হাজার পরিবারের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। হাজার খানেক পরিবার ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে পঞ্চায়েত থেকে বাড়ি পেয়েছে। আরও চার হাজার পরিবারকে সরকারি প্রকল্পে এক লক্ষ টাকার বেশি দামের পাকা বাড়ি হয়েছে। যেগুলির বেশির ভাগই হয়েছে আগের বাম সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের জমানায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পে জেলায় মাত্র ৩৯৫টি পাকা বাড়ি হয়েছে। এরমধ্যে জঙ্গলমহলের ৭ টি ব্লকে ২০৮ টি বাড়ি হয়েছে। এক একটি বাড়ির জন্য খরচ হয়েছে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, ইতিপূর্বে এলাকার অনুন্নয়ন ও বাসিন্দাদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এলাকায় উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পরে উন্নয়নের পাশাপাশি, ব্যাপক পুলিশের তল্লাশি ও জনসংযোগকে হাতিয়ার করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে খোদ জেলার এসপি ভারতী ঘোষের উদ্যোগে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়মিত দান খয়রাতির শিবির করা হয়। কিন্তু লোধা-শবরদের মাথায় ছাদ দেওয়ার দাবিটি উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে।
জল পেরিয়েই চলছে যাতায়াত। দেউলিয়া বাজারে পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।
লোধা-শবরদের সংগঠন ‘মেদিনীপুর লোধা শবর কল্যাণ সমিতি’র পক্ষ থেকে সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি সচিত্র তথ্য-তালিকা জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের বক্তব্য, বাম আমলে বেলপাহাড়ির আমলাশোলে অনাহার ও অপুষ্টিতে লোধা-শবরদের মৃত্যু হয়েছিল। তারপর থেকে লোধাদের উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে যথাযথ সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না লোধারা। প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী লোধা-শবরদের পরিস্থিতি আরও খারাপ। মেদিনীপুর লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাইচন্দ্র নায়েক বলেন, “লোধা-শবররা জঙ্গলের ডাল-পাতা সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন। সরকার রেশনে দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল দিয়ে খাদ্য নিশ্চয়তার আশ্বাস দিচ্ছে, অথচ প্রশাসনিকস্তরে লোধা-শবরদের মাথায় ছাদ দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। ‘মোস্ট ভেনারেবল ট্রাইব্যাল গ্রুপ’ ভুক্ত লোধা-শবরদের জন্য সরকারও উদাসীন।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৯টি ব্লকের মধ্যে ২০টি ব্লকে ১৭ হাজার লোধা-শবর পরিবারের বাস। মোট জনসংখ্যা প্রায় আশি হাজার। গৃহহীন পরিবারগুলি কোনও মতে তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঝুপড়িতে বাস করে। অনেকে আবার গাছতলায় থাকে। জেলায় লোধা-শবর সম্প্রদায়ের চাকরিজীবী পরিবার মাত্র ৩০৪টি। বাকিরা জঙ্গলের বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। জঙ্গলমহলে বসবাসকারী লোধা-শবরদের অবস্থাটা সব চেয়ে খারাপ। বেলপাহাড়ি ব্লকে মোট লোধা-শবর পরিবারের সংখ্যা ৮৬৫টি। এরমধ্যে শিমুলপাল, ভুলাভেদা ও বাঁশপাহাড়ি এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী ৮২টি পরিবার কার্যত গাছ তলায় বসবাস করছেন। লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সমীক্ষা অনুযায়ী, ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের লবনি, শাঁখাভাঙা, তিলডাহি, শিমুলপাল, কোদলবনি মতো গ্রামগুলিতে বসবাসকারী ৩২টি শবর পরিবার এখনও বাড়ি পায়নি। এ ছাড়া বাঁশপাহাড়ি পঞ্চায়েতের জড়িডাঙা গ্রামের ২০টি শবর পরিবারের মধ্যে ১৩টি পরিবারের বাড়ি নেই। লাগাদড়ি গ্রামের ২১টি পরিবারের মধ্যে ১১টি পরিবার গৃহহীন। পাটাঘর গ্রামের ৪৬টি শবর পরিবারের মধ্যে ১৮টি পরিবার এখনও বাড়ি পায়নি।
বলাইবাবুর বক্তব্য, “আমাদের চাহিদা খুবই অল্প। সমাজের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের চাকরি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পানীয় জল ইত্যাদি। অথচ এখনও লোধা-শবরদের অনুন্নয়নের অন্ধকারে পথ হাতাড়াতে হচ্ছে। প্রশাসন সক্রিয় না হলে এ বার আমরা পথে নামব।” জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “লোধা-শবরদের বাড়ি তৈরির জন্য জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের মাধ্যমে কেন্দ্রের কাছে আরও ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে লোধা-শবরদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।” উত্তরাদেবীর অভিযোগ, কেন্দ্রই বরাদ্দ দিতে গড়িমসি করছে বলে লোধাদের উন্নয়ন-কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy