মৃত ভোলানাথ দাসের মা বুলু দাস। মৃতের বাড়িতে মশার লার্ভা মারতে ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে (ইনসেটে)। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
কলকাতার হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়ে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলেন স্ত্রী। শেষকৃত্যের জন্য অসুস্থ অবস্থাতেই এসেছিলেন ডেবরা। সে কাজ মিটতেই ফের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে ডেঙ্গিতে মৃত ভোলানাথ দাসের (২৯) স্ত্রী সুচিত্রাকে।
ডেবরার মাড়তলার সত্যপুর গ্রামের দাস পরিবারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। গত তিনমাসে এই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার কলকাতার একটি নার্সিংহোমে মারা যান ভোলানাথ। তার মৃত্যুর শংসাপত্রে ‘সিভিয়ার ডেঙ্গি উইথ মাল্টি অর্গান ফেলিওর’ লেখা রয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর মারা গিয়েছিলেন ভোলানাথের বাবা বিশ্বেশ্বরের। তার আগে গত ১১ সেপ্টম্বর মৃত্যু হয়েছিল বিশ্বেশ্বরের খুড়তুতো ভাই সন্ন্যাসী দাসের। পরিবারের দাবি, তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে। তবে বাকি দু’জনের ডেথ সার্টিফিকেটে অবশ্য ডেঙ্গি কথাটির উল্লেখ নেই। তাতে অবশ্য ক্ষোভ কমছে না স্থানীয়দের। তাঁদের অভিযোগ, ডেবরার বিস্তীর্ণ অংশ এখন ডেঙ্গির আঁতুড় ঘর হয়ে রয়েছে।
পরিসংখ্যানও বলছে এক কথা। চলতি বছরে জেলায় ৮৫৩ জন ডেঙ্গি আক্রান্তের মধ্যে শুধুমাত্র ডেবরায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৭৩জন। এ দিন ভোলানাথের বাড়ির চারপাশে ডেঙ্গির উপযুক্ত পরিবেশ দেখা গেল। বাড়ির পিছনেই ড্রাম ভর্তি জলে মশার লার্ভা কিলবিল করছে। চারপাশে কলাগাছ, শুকনো পাতার স্তুপে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ভনভন করছে মশা। জমে থাকা ছোট-ছোট প্লাস্টিকের গ্লাস, আইসক্রিমের বাটিতে জমে রয়েছে জল। শুধু দাস পরিবারের বাড়ির চারপাশ নয়। সত্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের পিছন অবস্থিত গোটা গ্রামটার অবস্থাই প্রায় একরকম। মঙ্গলবার রাতেই জ্বর নিয়ে ডেবরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে ওই গ্রামের বাসিন্দা সুরজিৎ চাকলাদার ও শেখ জব্বর খানকে।
ক্রমশ ছড়াচ্ছে ডেঙ্গি। ফলে আতঙ্কে গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বাড়ছে ক্ষোভও। গ্রামে শেষ কবে লার্ভা মারার স্প্রে হয়েছে কেউ বলতে পারছে না। হাসপাতালে ভর্তি সুরজিতের বাবা বিশ্বেশ্বর চাকলাদারের কথায়, “এলাকায় মশার উপদ্রবে টেকা দায়। আমরা জেলাশাসককে চিঠি দিয়েছিলাম। তার পরে স্বাস্থ্যকর্মী মাঝেমধ্যে গ্রামে এসেছে। কিন্তু পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হয়নি। আর মশার লার্ভা মারার স্প্রে করা হয়নি।” এর আগে ডেবরার দলপতিপুরে ডেঙ্গিতে এগিয়ে গিয়েছিল। এখন সেখানে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হওয়ায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ওই এলাকায় কমেছে। কিন্তু সত্যপুরের পরিবেশ কেন বদলায়নি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয় সত্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পিয়ালি পাত্র বলেন, “পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমাদের যা করার তা করেছি ও করছি।” ডেবরার বিধায়ক তথা রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সেলিমা খাতুন বলছেন, “মানুষ সচেতন না হওয়ায় এমন পরিবেশ হয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কাজ হয়নি এমন নয়। তবে এবার আরও নিবিড়ভাবে পরিচ্ছন্নতায় জোর দিতে হবে।”
মালদহে কর্মরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভোলানাথ বদলির বিজ্ঞপ্তি নিতে গত ২০ নভেম্বর ডেবরার বাড়িতে এসেছিলেন। তার পরে গত ২৪নভেম্বর ফের মালদহে ফিরে গত ২৬নভেম্বর জ্বরে আক্রান্ত হলে গত বৃহস্পতিবার কলকাতায় ভর্তি করা হয় তাঁকে। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে স্বামী ও ছেলেকে হারিয়ে শোকার্ত ভোলানাথের মা বুলু দাস বলেন, “গ্রামে এই ডেঙ্গির প্রকোপে কেউ থাকতে চাইছে না। সবাই পালাচ্ছে। গ্রাম সুনসান হয়ে গিয়েছে। আমি কী নিয়ে বাঁচব! আমি চাই এমন পরিস্থিতির বদল হোক। আর কারও যেন ক্ষতি না হয়। সবাই সুস্থ হোক।” তিন ভাইয়ের পরিবারে ভোলানাথ ছোট। বড়দা স্বাস্থ্যকর্মী সোমনাথ দাস ও মেজদা স্কুল শিক্ষক যদুনাথ দাসের স্ত্রী ও সন্তানেরা বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। যদুনাথ বলেন, “ঘরে-ঘরে জ্বর। তার পরে আমাদের পরিবারে তিনজনের ডেঙ্গিতে মৃত্যুর পরে কেউ গ্রামে থাকতে চাইছে না। স্ত্রীরা সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়েছেন। আমরা ভাবছি গ্রাম ছাড়ব।”
আশ্বস্ত করছেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা। তাঁর কথায়, ‘‘এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা গিয়েছেন। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy