এভারেস্টের পথে একের পর এক দুর্ঘটনার খবর যত পাচ্ছি, ততই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। জানি না, আরও কত খারাপ খবর শুনতে হবে। মলয়রা (মলয় মুখোপাধ্যায়) ভাল ভাবে বেস ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছে জেনে স্বস্তি পাচ্ছি। রাজীব ভট্টাচার্যের পরে সুভাষ পালের মৃত্যুর খবরটা মর্মান্তিক। আসলে, এ বারে অভিযাত্রীর সংখ্যা বেশি বলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেশি বলে মনে হচ্ছে।
এতগুলো টিম গিয়েছে এভারেস্টে। এখানে বাঙালি বা অবাঙালি প্রসঙ্গ অবান্তর। প্রশ্নটা হল, আরও একটু সতর্ক হলে কি দুর্ঘটনার সংখ্যা আর একটু কমানো যেত? এই প্রসঙ্গে ঢোকার আগে একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। যে কোনও পর্বতাভিযানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতেই পারে। প্রবল ঝঞ্ঝা বা তুষারপাতও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। কিন্তু, ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গে অভিযান চালানোর আগে অন্তত সাত হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতাভিযান চালানো খুব প্রয়োজন। তা হলে কোনও পর্বতারোহী তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পর্যালোচনা করতে পারবে। এভারেস্ট বা আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বাভিযান চালানোর মতো অভিজ্ঞতা বা মানসিক জোর আমাদের সবার আছে তো? এমনিতেই আট হাজার মিটারের উপরে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় বাঁচতে পারে না। কৃত্রিম অক্সিজেন লাগে। তা ছাড়া, শরীরের বিভিন্ন কোষ মরে যায়। ওই উচ্চতায় টিকে থাকতে গেলে বাড়তি মেহনত ও লাগাতার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আমি মনে করি, এমন অনেকেই আজকাল এভারেস্ট অভিযানে যাচ্ছেন, যাঁদের যথাযথ অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ নেই। উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাবের কথা আজকাল আর ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, আজকাল এজেন্সিগুলোই সে সবের মধ্যে অধিকাংশ সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
আমি ’৯০ সাল থেকে পাহাড়ে যাচ্ছি। নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সে সব আপনারা জানেন। ২০১০ সালে প্রথম যখন এভারেস্ট অভিযানে যাই, তখন আমার বয়স ৪৯। এমনিতে বাঁশদ্রোণীর মিলন সমিতির মাঠে ১০ পাক করে দৌড়ই। কিন্তু এভারেস্ট অভিযান শুরুর প্রস্তুতি পর্বে ৩০ পাক করে দৌড়তাম। শুধুমাত্র দলের পাঁচ জনের মেডিক্যাল টেস্ট করাতেই লেগেছিল ৩০ হাজার টাকা। তা-ও অনেক কম রেটে। আসলে, পর্বতারোহীর শারীরিক সক্ষমতা কতটা সেটা তাকেই ভাল করে বিচার করতে হবে। আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় পর্বতারোহী শুধুমাত্র শেরপাদের ভরসায় থাকতে পারে না। তাকে নিজের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার একেবারে তুঙ্গে থাকতে হয়। এ বারেও মনে হচ্ছে, অনেকেই তাদের শারীরিক সক্ষমতার বাইরে গিয়ে শেষ মুহূর্তের অভিযানে বেরিয়েছিল। শুধু তো শিখর জয়ই নয়, পর্বতারোহীকে শৃঙ্গ থেকে নিরাপদে নেমে আসার পথটাও করে রাখতে হয়। অনেকেই মনে করছে, এত দূর যখন এসেই পড়েছি, তখন একটু অসুবিধা হলেও সামিট করে তবেই ফিরব। ছন্দাও একই ভুল করেছিল।
হিসেবের বাইরে অভিযান ধীর গতিতে চললে বা কোনও কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে কৃত্রিম অক্সিজেনের অভাব ঘটবেই। সেই খেয়ালও রাখতে হবে। যদি কোনও কারণে মনে হয়, এ বারে আর এগোনো উচিত নয়, ফেরার পথে অক্সিজেনে টান পড়তে পারে, তখন সেই অভিযান থেকে ফেরা উচিত।
তুষার ক্ষতের (ফ্রস্ট বাইট) জন্য বেশির ভাগ সময় পর্বতারোহীদের গাফিলতি ও অভিজ্ঞতার অভাবই দায়ী। কোনও কারণে মোজা ভিজে গেলে তা না পাল্টালে, গরম জল না পেলে, অনেক ক্ষণ চলাফেরা না করে বসে থাকলে তুষার ক্ষত হয়ে যায়। এ বারেও মনে হচ্ছে এ রকমই কিছু হয়েছে।
এ বারে পর পর দুর্ঘটনার পরে শেরপাদের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রসঙ্গ শুনছি। কিন্তু আমি এখনও শেরপাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কোনও দৃষ্টান্ত পাইনি। রাজীব যেখানে মারা গেল, সেই ধৌলাগিরিতেই ২৫ হাজার ফুটের উপর যখন মরতে বসেছিলাম, তখন পেম্বা শেরপা আমায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে তিন নম্বর ক্যাম্পে নেমে গিয়েছিল। তার উপরে ভার ছিল দেবাশিস বিশ্বাসকে বাঁচানোর। কারণ, আমার থেকে ১০ বয়স কম হওয়ার কারণে দেবাশিসের শারীরিক অবস্থা তুলনায় ভাল ছিল। পেম্বা সেই কাজটাই করেছিল। পরের দিন সকালে সে অন্য শেরপা পাঠায় অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে। এটাকে কি ছেড়ে যাওয়া বলে? ও তো জানতই, আমি যে কোনও সময় মারা যেতে পারি। আমিও জানতাম, ওই অবস্থায় কত ক্ষণ যুঝতে পারব, তা তো নিজেই জানি না। কিন্তু শেরপারা কী করবে? যেখানে উদ্ধার করার কোনও উপায়ই নেই সেখানে সে-ও কি পর্বতারোহীর সঙ্গে বসে থাকবে মরার জন্য? বরং, সে নীচে নামতে পারলে অন্যদের খবর দিতে পারবে। কেউ কেউ আবার ছেড়ে যায়ও না। আসলে শেরপাদের সঙ্গে পর্বতারোহীদের একটা ‘বন্ডিং’ তৈরি হয়। এই ‘বন্ডিং’টা খুবই জরুরি। এটাও অনেক অভিযানের মধ্য দিয়ে হয়। হঠাৎ ঠিক করলাম, এভারেস্টে যাব, আর যে কোনও এজেন্সি ধরে চলে গেলাম, তা হতে পারে না।
প্রতিটি মৃত্যুই ভয়ঙ্কর। স্বজন হারানোর ব্যথা পাচ্ছি। কিন্তু কিছু সতর্কতা নিলে ভবিষ্যতে এই সব দুর্ঘটনা কমানো যাবে। সেটাই কাম্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy