Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

নতুন হৃৎপিণ্ড শুধু নয়, নতুন হৃদয়ও

২০১৯ সালের শুরুটা যে দেখে যেতে পারবেন, এক সময় সেই বিশ্বাসটাই ছিল না।

পরিবারের সঙ্গে দিলচাঁদ সিংহ। নিজস্ব চিত্র

পরিবারের সঙ্গে দিলচাঁদ সিংহ। নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৯
Share: Save:

রাতে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, মাঝে মাঝে বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করেন, ধুকপুক শব্দটা সত্যিই হচ্ছে তো! ঘুমন্ত স্ত্রী, সন্তানের দিকে চোখ চলে যায় বার বার। মধ্য চল্লিশের দিলচাঁদ সিংহ অনুভব করেন বেঁচে থাকা কতটা মধুর!

২০১৯ সালের শুরুটা যে দেখে যেতে পারবেন, এক সময় সেই বিশ্বাসটাই ছিল না। ২০২০-র মুখে দাঁড়িয়ে এখন সামনে অনেক লম্বা পরিকল্পনা তাঁর। বাড়িটা সারাতে হবে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া-চাকরি, স্ত্রীর অনেক শখ-আহ্লাদ পূরণ বাকি। স্কুলে যে বাচ্চাগুলো রোজ সকালে স্যর-স্যর বলে ছুটে আসে, পাড়ার যে সব লোক সব সময় পাশে দাঁড়ান, তাঁদের জন্যও ভাবতে হবে!

এ রাজ্যে প্রথম সফল হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বাসিন্দা দিলচাঁদের। ২০১৮ সালের মে মাসে, ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে। তার পরে একে একে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আরও বেশ কয়েকটি হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। কিন্তু তার স্বাস্থ্য মানচিত্রে দিলচাঁদের নামটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। ঠিক যে ভাবে এই শহরের জন্য আলাদা জায়গা দিলচাঁদের মনেও। আপাতত বছরে তিন বার চেকআপে আসতে হচ্ছে। এ ছাড়াও অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে যে কোনও অনুষ্ঠানে ডাক পড়লে অন্য সব কাজ ফেলে ছুটে আসছেন তিনি।

রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান, হালকা খাওয়াদাওয়া করে ঝাঁঝির বাড়ি থেকে বাস ধরতে বেরোন। পাঁচ কিলোমিটার দূরে স্কুল। পর পর কয়েকটা ক্লাস। তার পর পড়ুয়ারাই ঠেলে স্যরকে পাঠিয়ে দেয় একটা ঘরে। বিশ্রাম নিতে হবে তো! স্যর চান বা না চান, তাঁকে খাইয়েদাইয়ে ঘরে শুতে পাঠায় তাঁরা। দিলচাঁদ বলেন, ‘‘আমি যদি রাজি না হই, তখন অন্য স্যরদের ডেকে আনে ওরা। ওঁরাই ধমকধামক দিয়ে আমাকে বিশ্রাম নিতে পাঠান।’’

আরও পড়ুন: ক্যানসার-যুদ্ধে তথ্যের অভাবই এখন বড় সমস্যা

বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, চার সন্তান। তবে অস্ত্রোপচারের পরে দিলচাঁদের দায়িত্ব যেন শুধু পরিবারের নয় আর। গোটা গ্রাম, গোটা স্কুল, চারপাশের সকলে যত্নে রাখতে চায় তাঁকে। স্কুলের শিক্ষকেরা এক বাক্যে বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা ওঁকে নতুন জীবন দিয়েছেন। বাকিটা তো আমাদের সকলকে সামলাতে হবে।’’

কেমন আছেন এখন দিলচাঁদ? নিজে দাবি করছেন, ‘‘১০০ শতাংশ ভাল আছি।’’ যে চিকিৎসক দলের তত্ত্বাবধানে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছিল, ফর্টিস হাসপাতালের সেই চিকিৎসক কে এম মান্ডানা জানাচ্ছেন, সদ্য মায়োকার্ডিয়াল বায়োপসি হয়েছে। রিপোর্ট যথেষ্ট ভাল।

দিলচাঁদের শরীর অন্যের শরীরের অঙ্গকে প্রত্যাখ্যান করছে না। স্বাভাবিক জীবনযাপন কতটা সম্ভব? তিনি বলেন, ‘‘সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হয়। উনি বাসে যাতায়াত করেন। তাই মাস্ক পরতে বলেছি।’’

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গোটা বিশ্ব জুড়েই হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হার এখন যথেষ্ট বেশি। মান্ডানার কথায়, ‘‘৮৫ শতাংশ মানুষ অস্ত্রোপচারের পরে অন্তত ১০ বছর বাঁচছেন।’’ তবে ওষুধ খেয়ে যেতে হয় আজীবন। খরচ বছরে এক থেকে সওয়া লাখ টাকার মতো।

চোখ, কিডনি, লিভার পেরিয়ে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছনোর রাস্তায় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রচুর। সে সব সামলে আপাতত আত্মবিশ্বাসী এই রাজ্য। পিছিয়ে নেই সরকারি হাসপাতালও। এ বঙ্গে সরকারি পরিকাঠামোয় প্রথম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয় রানিগঞ্জের বাসিন্দা ৩৮ বছরের রাখাল দাসের। গত বছর নভেম্বরে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার পর একে একে আরও অস্ত্রোপচার হয়েছে মেডিক্যালে, এসএসকেএমে। যেমন, ছ’মাস পেরিয়েছে এসএসকেএমে প্রতিস্থাপন করানো মৃন্ময় বিশ্বাসের। এখনও কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। মৃন্ময় বললেন, ‘‘তিরিশেই জীবনটা শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য ডাক্তারবাবুদের কাছে আমার ঋণ কখনও শোধ হওয়ার নয়।’’ এই রাখাল-মৃন্ময়রা নিজেদের অস্ত্রোপচারের আগে দিলচাঁদের কথা শুনেই সাহস অর্জন করতে চেয়েছেন। এখনও যে কোনও অসুবিধায় তাঁদের মনে প্রথম প্রশ্নটাই আসে, ‘আচ্ছা, দিলচাঁদ ভাইয়েরও কি এমন হয়?’ মাঝেমধ্যে এমন অনেক ফোনও পান দিলচাঁদ। হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘কেউ চিনত না। এই অসুখটা আমাকে সেলিব্রিটি বানিয়ে দিল।’’

নতুন বছরে আর কী চান? একটু থমকে দিলচাঁদ বলেন, ‘‘অপারেশনের আগে নিজের চাকরি, জমিজমা, বউবাচ্চা নিয়েই মেতে থাকতাম। কেউ কিছু চাইলে দু’বার ভাবতাম। কিন্তু এখন চেষ্টা করি, যাতে কাউকে না ফেরাতে হয়।’’ নবজন্ম পেয়ে মনটাই বদলে গেল? উত্তর আসে, ‘‘আসলে অন্যের হার্ট আমার কাছে গচ্ছিত আছে তো! বেঙ্গালুরুর ৩৫ বছরের যে ছেলেটা জীবনের অনেক কিছুই না দেখে মরে গেল, তার দয়ায় আমি বেঁচে আছি। তার হার্ট আমার মতো অতি সাধারণ একটা মানুষকে বাকিদের জন্য ভাবতে শিখিয়েছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Health Heart Transplant Organ Donation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy