শিল্পপতিদের সঙ্গে লন্ডন সফর নিয়ে একটি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। বৃহস্পতিবার নবান্নে। ছবি: প্রদীপ আদক।
সাফল্যের আকাশছোঁয়া দাবি আর নয়। লন্ডন সফরের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকপট স্বীকারোক্তি, তিরিশ শতাংশ কাজ হলেই আপাতত তিনি ‘খুশি’।
অর্ধশত শিল্পপতি-সহ সপারিষদ মু্খ্যমন্ত্রীর কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু রবিবার সকালে। ওই দিন রাতে লন্ডন পৌঁছে পর দিনই দু’দেশের শিল্প-প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রিটেনের কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী প্রীতি পটেলের আলোচনা, বণিক সম্মেলনে মমতার বক্তৃতা এবং মউ সই পর্ব।
মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জানান, তাঁর এই সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গ ও ব্রিটেনের মধ্যে বিনিয়োগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত ২৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এর মধ্যে শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব ধরনের প্রকল্প আছে। যেমন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চারটি চুক্তি। ১। হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভিল্যান্স, সঙ্গে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন, ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল হেল্থ। ২। হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভিল্যান্স, সঙ্গে দ্য লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ৩। ইনস্টিটিউট অব হেল্থ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার, সঙ্গে রয়্যাল কলেজ অব জেনারেল প্র্যাকটিশনার ফর টেকনিক্যাল সাপোর্ট।
৪। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট হেল্থ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ডামডি, স্কটল্যান্ড। প্রথম দু’টি জনস্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ক, তৃতীয়টি ফ্যামিলি মেডিসিন বিষয়ক, চতুর্থটি ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাডভান্সড নার্সিংয়ে প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী এ দিনই জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (এসওএএস) দু’টি স্কলারশিপ চালু করছে। মাস্টার্স এবং পিএইচডি স্তরে প্রতি বছর দু’জন কৃতী এই ‘বিশ্ব বাংলা’ বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন।
শিল্প-বাণিজ্য জগতের যে বিশাল দল তাঁর সঙ্গে লন্ডন যাবে, সেখানে রাজ্যে পরিচিত মুখ প্রায় সবাই আছেন। যোগী দেবেশ্বর, সঞ্জীব গোয়েন্কা, হর্ষ নেওটিয়া, হর্ষ লোঢা, কর্ণ পল থেকে শুরু করে অ্যাপোলো টায়ার্সের ওঙ্কার কানোয়ার, অ্যাপোলো হাসপাতালের সঙ্গীতা রেড্ডি, ভিডিওকনের অনিরুদ্ধ ধুত, বণিকসভা ফিকি-র প্রেসিডেন্ট জ্যোৎস্না সুরি-সহ ৪৮ জনের নাম ইতিমধ্যেই তালিকায় উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এর বাইরেও কয়েক জন আছেন। ফলে সংখ্যা ৫০ পৌঁছে যাবে।’’
এর আগে এত বড় বাণিজ্য প্রতিনিধি দল নিয়ে কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি বিলেত গিয়েছেন? মমতার কটাক্ষ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে ধারণাটাই তো গোটা জগতের কাছে খারাপ করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলা শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের মানবসম্পদের রাজধানী। আমরা সেই বাংলাকে এখন তুলে ধরছি।’’
কিন্তু লন্ডন সফর থেকে কী প্রত্যাশা তাঁর? এর আগে সিঙ্গাপুর সফর এবং তারও আগে দিল্লি ও মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলন এবং একাধিক বেঙ্গল লিডসের আয়োজন থেকে কাজের কাজ কিছু হয়নি বলেই সরব বিরোধীরা। রাজ্য যে শিল্পের মুখ দেখেনি, সে জন্য কাঠগড়ায় মমতার জমি নীতি থেকে শুরু করে শাসক দলের মদতে তোলাবাজি এবং সিন্ডিকেট রাজ। এই বাতাবরণে মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরও যে মরা গাঙে কতটা বান আনতে পারবে, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় থেকেই যায়।
মমতা অবশ্য এত কাল সরকার পরিচালনার প্রায় সব ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সাফল্যের দাবি করতেই
অভ্যস্ত ছিলেন। পাঁচ বছরে যা করার কথা, বছর ঘুরতেই তা সেরে ফেলেছেন, এমন দাবি অতীতে শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে যা মিলুক বা না-মিলুক। আর সম্ভবত সেটা বুঝেই বিধানসভা ভোটের মুখে খানিকটা সচেতন ভাবেই সেই অবস্থান থেকে সরে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। ইদানীং তিনি স্বীকার করছেন, সবটা করা যায়নি। সম্প্রতি ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশেও যে তাঁর গলায় এমন সুর ছিল, তা অনেকেরই নজর এড়ায়নি।
এ দিন লন্ডন সফর থেকে প্রত্যাশার প্রশ্নেও যথেষ্ট সংযত ছিলেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘স্বপ্নের তো শেষ হয় না। প্রত্যাশা থাকেই। কোনও দিন আমাদের রাজ্যকে নিয়ে বিপণনের চেষ্টাই হয়নি। আমরা শুরু করেছিলাম শূন্য থেকে।’’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মন্তব্য, ‘‘শূন্য নয় ম্যাডাম, মাইনাস থেকে।’’ এ বার সেই ‘মাইনাস’ মুখে তুলে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলতে থাকেন, ‘‘হ্যাঁ, মাইনাস থেকে শুরু করেছি। রাতারাতি ১০০ ভাগ করে ফেলব এমন দাবি করার মতো অদূরদর্শী নই। যদি ৩০% ও করতে পারি জানব করতে পারছি।’’
লন্ডন সফরের প্রথম দিনেই ডিউক অব ইয়র্ক রাজকুমার অ্যান্ড্রুর আমন্ত্রণে বাকিংহাম প্রাসাদে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। বাকি দিনগুলিতে তাঁর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এ রাজ্যের শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান। লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনার রঞ্জন মাথাইয়ের আমন্ত্রণ রক্ষা এবং বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক। তবে লন্ডন বিজনেস স্কুলে বক্তৃতার কর্মসূচি বাতিল হয়েছে। মমতা জানান, গরমের ছুটি থাকায় পড়ুয়া, শিক্ষক অনেকেই এখন নেই। তাই আমন্ত্রণ থাকলেও এ বার তিনি সেখানে যাচ্ছেন না।
মমতার সফরসঙ্গী হচ্ছেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। আর কলকাতার পুলিশ কমিশনার তো ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন লন্ডনে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে বৈঠক আছে তাঁর। একদা কলকাতা পুলিশকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে তার দক্ষতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। যার পিছনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। লন্ডনের বৈঠক থেকে শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধের তদন্তের কাজে গৌরব পুনরুদ্ধারের পাঠ নিয়ে কমিশনার ফেরেন কি না, তা সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy