প্রথমে নবান্ন অভিযান। তার পরে সাধারণ ধর্মঘট। এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর দুই কর্মসূচিকে হাতিয়ার করে পথে নেমে শাসক দল ও প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর নিল বামেরা। এবং পিঠোপিঠি এই দুই ঘটনার সূত্রেই রাজ্য রাজনীতিতে আবার প্রবল যুযুধান হিসাবে মুখোমুখি দাঁড়াল তৃণমূল এবং বাম!
কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মোট ১৭ দফা দাবিতে বুধবার দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রে়ড ইউনিয়ন। যার মধ্যে বামেদের একাধিক সংগঠনের পাশাপাশি কংগ্রেস প্রভাবিত আইএনটিইউসি-ও ছিল। কিন্তু এ রাজ্যে সেই ধর্মঘটের পুরো ভাগে দেখা গিয়েছে বামেদেরই। ধর্মঘটের সমর্থনে এ দিন রাজ্যের নানা প্রান্তে সক্রিয় ভাবে পথে নেমেছিলেন বাম নেতা-কর্মীরাই। যার জন্য দিনের শেষে ধর্মঘটের নামে ‘গুন্ডামি’র দায় বামেদের ঘাড়েই চাপিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও স্পষ্ট করে বললে, চাঁছাছোলা ভাষায় নিশানা করেছেন সিপিএমকেই। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দিল্লিতে সিপিএম শূন্য হয়ে গিয়েছে। এখানেও কিছু নেই। যেটুকু আছে, ক’দিন পরে সেটাও শূন্য হয়ে যাবে!’’
নবান্ন অভিযান ও ধর্মঘট-পরবর্তী বামেরা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই বেশি আক্রমণাত্মক। বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘শূন্য করে দেওয়া’র চ্যালেঞ্জ তাই পত্রপাঠ গ্রহণ করে নিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র! নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী ওই ঘোষণা করে ওঠা মাত্রই আলিমুদ্দিনে বসে সূর্যবাবু বলে দিয়েছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমরা গ্রহণ করলাম। এর পরে আরও বড় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ওঁকে দেখতে হবে! চ্যালেঞ্জ করছি, লড়াইয়ের ময়দানে আবার দেখা হবে! রাজ্যের মানুষই এই নৈরাজ্যের জবাব দেবেন।’’ সামনে বিদ্যুৎ মাসুল বৃদ্ধি, টেট কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ, খাদ্য সুরক্ষার জন্য আবেদনের মেয়াদ বাড়ানোর দাবিতে নানা কর্মসূচিতে তাঁরা রাজ্য সরকারকে ব্যতিবস্ত রাখবেন বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।
বস্তুত, ধর্মঘটের দিনে রাজ্যের প্রায় সর্বত্র পথে নেমে বামেদের সক্রিয়তা এবং তার পরে মুখ্যমন্ত্রীকে সিপিএমের পাল্টা চ্যালেঞ্জ রাতারাতি আবার ভাবিয়ে তুলেছে শাসক দলকে। তাই মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার বাগ্যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তৃণমূল ভবনে আবার তড়িঘড়ি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল শাসক দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। প্রায় দলনেত্রীর কথারই প্রতিধ্বনি করে তিনি জানিয়েছেন, ধর্মঘটের নামে বামেদের ‘তাণ্ডবে’র প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতি ও কাল, শুক্রবার বিকাল ৪টে থেকে এক ঘণ্টা করে ‘ধিক্কার দিবস’ পালন করা হবে। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘বাংলার মানুষ বন্ধ বা হিংসাত্মক রাজনীতি চায় না। রাস্তায় সিপিএমের হিংসাত্মক তাণ্ডবের বিরুদ্ধে তাই তাদের ধিক্কারে সামিল হতে বলছি।’’ পার্থবাবু এই ঘোষণা করার আগেই অবশ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়ে দিয়েছেন, ধর্মঘট ভাঙার নামে শাসক দল ও পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজ ১৭টি বাম দল রাজ্য জুড়ে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করবে। যার অর্থ আজ আবার রাস্তায় পরস্পরের বিরুদ্ধে সেই বাম ও তৃণমূল!
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য রাজনীতির সমীকরণের চাকা আবার কী ভাবে ঘুরে গেল বাম-তৃণমূলের মুখোমুখি লড়াইয়ের দিকে? বাম সূত্রের বক্তব্য, রাস্তায় নেমে আন্দোলনের চেনা কৌশলে ফিরে গিয়েই বিরোধী রাজনীতির পরিসরে আবার প্রবল ভাবে ফিরে আসতে পেরেছে তারা। গত চার বছরে মমতার সরকারের নানা কাজকর্মে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হলেও বামেদের কেন সে ভাবে পথে দেখা যাচ্ছে না, এই প্রশ্ন বারবার উঠেছে। সূর্যবাবুরা বারবারই বলে এসেছেন, নতুন সরকারকে তাঁরা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। নিজেদের সংগঠনকে গুছিয়ে নেওয়ার তাগিদও ছিল। এখন বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে তাঁরা সেই স্ব-আরোপিত লক্ষ্ণণরেখা পেরোতে চাইছেন। বিধানসভা ভোটে তার ফল কী হবে, পরের কথা। আপাতত জনমানসে বাম নেতৃত্ব বার্তা দিতে চাইছেন, তাঁরা পথে নেমে লড়াইয়ে আছেন। যে কারণে মমতার জমানায় এ দিনই প্রথম ধর্মঘটের সমর্থনে সকাল থেকেই রাস্তায় দেখা গিয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক থেকে বামফ্রন্টের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের। বামেরা যত পথে নেমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে, ততই তাদের উপরে শাসক দলের হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। বহরমপুরে প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, মহম্মদবাজারে বিধায়ক ধীরেন বাগদি, হরিহরপাড়ায় বিধায়ক ইনসার আলির মতো অনেক বাম নেতা-কর্মীই ভাল রকম জখম হয়েছেন। আক্রমণ হচ্ছে মানে শাসক দল ভয় পেয়েছে, এই বার্তা নিয়ে আরও তৎপরতার সঙ্গে নেমে পড়েছেন সূর্যবাবু-বিমানবাবুরা।
বাম নেতৃত্বের দাবি, প্রবল আক্রমণ মোকাবিলা করেও এ দিনের ধর্মঘট ‘সফল’। শাস্তির ভয়ে সরকারি দফতর ছাড়া আর কোথাওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। ট্রেন এবং সরকারি পরিবহণ চলেছে। বেসরকারি পরিবহণ কম। কিন্তু তাতে যাত্রী আরও কম! চা-বাগান থেকে চটকল, শিল্পের ঝাঁপ প্রায় বন্ধ। যদিও ঘটনা হল, যে কেউ ধর্মঘট ডাকলেই ঘরবন্দি থাকা এ রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষের মজ্জাগত অভ্যাস! তাতে বামেদের বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করার কিছু নেই! মূল্যবৃদ্ধি বা পেনশন-পিএফের টাকা শেয়ারে খাটনোর প্রতিবাদে এ বারের ধর্মঘটের কিছু দাবির সঙ্গে আম জনতার একাংশের সহমর্মিতা ছিল ঠিকই। কিন্তু সাধারণ ভাবেই আম বাঙালির কিছু অংশ যেমন ছুটির মেজাজে ধর্মঘট কাটান, তেমনই আর এক অংশ আবার গোলমালের ভয়ে রাস্তায় বেরোন না। নবান্ন অভিযানে বাম-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধের পরে এ বারের ধর্মঘট নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল সমূহ।
এবং এই সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভূমিকাকে এ দিনের ধর্মঘট ‘সফল’ হওয়ার পিছনে পরোক্ষ কারণ হিসাবে মেনে নিচ্ছে আলিমুদ্দিনের একাংশই! সিটুর রাজ্য সম্পাদক দীপক দাশগুপ্ত যেমন ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিয়েছেন, ‘‘এ বারের ধর্মঘটের জন্য নিবিড় প্রচার চালানো হয়েছিল সবক’টি ইউনিয়ন মিলে। কিন্তু শেষ দিকে এসে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে হিংস্র ভঙ্গিতে হুমকি দিতে শুরু করেছিলেন, সেটাই আমাদের কাজ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে!’’ বাম নেতাদের একাংশই বলছেন, ধর্মঘট ঠেকাতে মরিয়া হয়ে একের পর এক সরকারি নির্দেশ জারি করে মুখ্যমন্ত্রীই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এই ধর্মঘট যেন জীবন-মরণের প্রশ্ন! তাতে সাধারণ মানুষের একাংশ যেমন সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন, তেমনই ধর্মঘটীদের জেদ বেড়ে গিয়েছে। আর দিনের শেষে বাম নেতারা দাবি করতে পেরেছেন, ধর্মঘট ‘সর্বাত্মক’!
এর সঙ্গেই দ্বিতীয় কারণ হিসাবে উঠে আসছে বিজেপি-তৃণমূলের নৈকট্যের বাতাবরণ। সাধারণ ধর্মঘট ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। অথচ সেই ধর্মঘটকে ব্যর্থ করতে তৃণমূলের সরকার কেন এত সক্রিয়, এই প্রচারকে গত তিন দিনে প্রবল ভাবে তুলে এনেছিল বামেরা। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, ‘‘মোদীর জন্য মাঠে নেমেছেন দিদি। নেমে ফাউলও করছেন! এর পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যা বোঝার, বুঝে নেবেন!’’ ধর্মঘটী শ্রমিক সংগঠনগুলির তরফে শ্যামল চক্রবর্তী, রমেন পাণ্ডে, নরেন চট্টোপাধ্যায়, অশোক ঘোষ, বাসুদেব বসুরাও এই প্রশ্নই তুলেছেন যে, মোদীর বিরুদ্ধে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের উপরে তৃণমূল এবং পুলিশের মার কী বার্তা দিচ্ছে? একই ভাবে সিটুর তপন সেন, এআইটিইউসি-র গুরুদাস দাশগুপ্ত, ইউটিইউসি-র অবনী রায়ের মতো শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও প্রশ্ন তুলেছেন, বিজেপি-শাসিত নানা রাজ্যেও এ দিন ধর্মঘট হয়েছে। কোথাও সংঘর্ষ, রক্তপাত হয়নি। তা হলে তৃণমূল-শাসিত রাজ্যেই পুলিশ এবং শাসক দলকে ধর্মঘট ভাঙতে নামানো হল কেন?
শ্যামলবাবু, গুরুদাসবাবুদের এই প্রশ্নই আরও জোরালো হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে কিছু ঘটনাপ্রবাহে। স্বচ্ছ বিদ্যালয় পরিকল্পনার আওতায় স্কুলে শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ১০০%-রও বেশি সাফল্য পেয়েছে বলে মঙ্গলবার টুইট করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই তথ্যই রিটুইট করে এ দিন মমতার সাফল্যের দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন কলকাতায় দাবি করেছেন, ‘‘রাজ্য সরকার চাইলে ধর্মঘট রুখতে পারত। কিন্তু পুলিশ সক্রিয় হয়নি! সিপিএম-তৃণমূল গোপন বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। বিজেপি-কে ঠেকাতে সিপিএমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তৃণমূল।’’ এক দিকে প্রশাসনিক স্তরে মমতার পাশে মোদীর দাঁড়ানো এবং অন্য দিকে বামেদের নস্যাৎ করতে রাজ্য বিজেপি-র দাবি— এই সব ঘটনা দেখিয়েই শ্যামলবাবুরা দাবি করেছেন, ‘‘সেটিং হয়ে গিয়েছে!’’
তৃণমূল-বিজেপি’কে এক বন্ধনীতে রেখে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে এ বার কি তা হলে ‘সেটিং’ সেরে নেবে বাম-কংগ্রেস? ধর্মঘটে সমর্থন জানালেও প্রদেশ কংগ্রসকে এ দিন অবশ্য বামেদের মতো রাস্তায় দেখা যায়নি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ধর্মঘটে আইএনটিইউসি ছিল। কংগ্রেসের নৈতিক সমর্থন থাকলেও সক্রিয় ভাবে তাদের রাস্তায় নামার কথা ছিল না। তবে বামেদের পাশে দাঁড়িয়েই অধীরের অভিযোগ, তৃণমূল আশপাশের গ্রাম এমনকী জেলার অন্যান্য প্রান্ত থেকেও বহিরাগতদের এনে বহরমপুরে বামেদের ধর্মঘটে বাধা দিয়েছে। তাঁরা তখন পথে নামেনি কেন? অধীর বলেছেন, ‘‘আমরা তো আর তৃণমূলের হাত থেকে বামেদের রক্ষা করতে চৌকিদারি করতে পারি না! তার উপরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে শাসক দলের ওই তাণ্ডবে প্রশ্রয় দিয়েছে!’’
বাম-কংগ্রেস সুর মিলে যাওয়ার এই আবহেই পরবর্তী প্রশ্ন, ধর্মঘট কি বামেদের চাঙ্গা করে গেল? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবুর জবাব, ‘‘বামেরা চাঙ্গা কি না, সে তো ফলেন পরিচীয়তে! তবে মানুষ ধীরে ধীরে বুঝে নিচ্ছেন, কে কী করছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy