মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধন করা এক গুচ্ছ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কুলতলিতে সোমবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
সুন্দরবনের উন্নয়নে প্রকল্প। অথচ তার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নেই সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা এবং বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন! অনুপস্থিত সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীও।
বদলে ঝড়খালিতে ফুট ত্রিশেক দীর্ঘ মঞ্চে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠানটি আগাগোড়া পরিচালনা করলেন রাজ্যের পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। যা দেখে খোদ নবান্নের আমলা মহলেই প্রশ্ন উঠে গেল, হঠাৎ পরিবহণ সচিব কেন? সোমবার দুপুরে এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেল রাজ্যের সচিবালয়ে।
সরকারি বিজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, ওই সেতু-নির্মাণ প্রকল্পের যাবতীয় খরচ দিয়েছে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতর। অনুষ্ঠান কী ভাবে করা হবে, গত কয়েক দিন ধরে তার পরিকল্পনাও করেছে এই দফতর। এমনকী, দফতরের মন্ত্রী মন্টুরামবাবুর নামও ছিল বিজ্ঞাপনে। তা হলে তিনি বা দফতরের কোনও শীর্ষ কর্তার বদলে মঞ্চ সামলানোর দায়িত্ব পরিবহণ সচিবের উপর বর্তাল কেন? মন্টুরাম জানিয়েছেন, কুলতলির অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন। সেখান থেকে ঝড়খালিতে না এসে চলে যান বিধানসভায়। তবে কুলতলিতে হাজির কেউই তাঁকে দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না।
বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলেন, “বিধানসভায় ব্যস্ত ছিলাম। তাই আর যাওয়া হল না।” তবে নবান্নে কেউ কেউ বলছেন, বিনয়বাবুকে বিধানসভাতেই থাকতে বলা হয়েছিল। আর বারবার ফোন করেও সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীর সাড়া পাওয়া যায়নি। জবাব দেননি এসএমএস-এর।
এর আগে কখনও কোনও দফতরের মন্ত্রী-সচিবকে বাদ দিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে কি না, চট করে মনে করতে পারলেন না নবান্নের কেউ। একমাত্র উদাহরণ মদন মিত্র। সারদা নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ার পর হঠাৎই পরিবহণ মন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিলেন মমতা। তখন পরিবহণ দফতরের কোনও কোনও অনুষ্ঠানে মদনকে ডাকা হয়নি, কোথাও আবার উদ্বোধনের কাজ সারা হয়েছিল অন্য মন্ত্রীকে দিয়ে।
কিন্তু সোমবার হঠাৎ কেন মন্টুরাম বা নন্দিনীকে মঞ্চে না তুলে পরিবহণ সচিবে সভা পরিচালনার ভার দেওয়া হল? নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা জানালেন, “সরকারি অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-আমলাদের কে গুরুত্ব পাবেন, তা স্থির করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরটা রয়েছে একমাত্র তাঁর কাছেই।”
অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন অবশ্য এখানেই শেষ নয়। অনেকেই জানতে চাইছেন, সোমবার যে মৃগাঙ্গনা নদীর সেতু এবং ঝড়খালির ইকো ট্যুরিজম পার্ক উদ্বোধন করে সাফল্যের দাবি করলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেগুলি কি আদৌ নতুন? সরকারি সূত্র বলছে, দু’টি প্রকল্পই আদতে বাম আমলের।
মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য তা নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। ‘নতুন কাঁচিতে পুরনো ফিতে কেটে’ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিচ্ছেন, “আমি যা বলি তাই করি। প্রথমে শিলান্যাস করি। পরে এসে ‘ফাউন্ডিং’ করি।” কুলতলির অম্বেডকর কলেজ মাঠ থেকে সেতু উদ্বোধন করেন মমতা। তার পরে বলেন, “৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু তৈরি করা হয়েছে। সুন্দরবনের প্রায় অর্ধেক যোগাযোগ ব্যবস্থা সারা হয়ে গেল।” জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০’র জুন মাসে বাম আমলেই এই সেতুর নির্মাণ পরিকল্পনা বাবদ বরাদ্দ অনুমোদন হয়েছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল নির্মাণ কাজও। জেলা প্রশাসনের এক কর্তাও একই কথা জানান। তাঁর বক্তব্য, মথুরাপুর-২ ব্লকের সঙ্গে পাথরপ্রতিমা, হেরম্বচন্দ্রপুর, লক্ষ্মী-জনার্দনপুর, অচিন্ত্যনগরের যোগাযোগ গড়ে তুলতেই তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এই সেতু তৈরির কাজ শুরু করেছিল।
প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “তৃণমূল যখন ক্ষমতায় আসে, সেতুর কাজ তো অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কাজ শেষ করতে এত দিন লাগল কেন বলুন তো!” এই বক্তব্যের রেশ টেনেই সিপিএমের অভিযোগ, পুরনো কাজ এত দিনে শেষ করে হাততালি কুড়োনোর চেষ্টা করছেন মমতা।
বাসন্তীর ঝড়খালির ইকো পার্ক গড়তে সরকারি অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, “পিপিপি মডেলে ৪০০ কোটি টাকায় প্রকল্পটি গড়ে তোলা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে হোটেল-ফোটেল চিড়িয়াখানা হবে।” তিনি জানান, সুন্দরবনের বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তুর ঠাঁই হবে এখানে। কিন্তু এ প্রকল্পও কি নতুন?
বাম আমলের বনমন্ত্রী অনন্ত রায় বলেন, “কী তুঘলকি কাণ্ড বলুন! ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঝড়খালির ওই ব্যাঘ্র পুনর্বাসন প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। আর আজ তা হয়ে গেল মমতার সাফল্য!”
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রকল্প খাতে প্রাথমিক ভাবে ৫ কোটি অনুমোদন করা হয়েছিল। কাজও শুরু হয়েছিল। প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর জানান, চলতি জমানার ধাঁচে ‘ট্যুরিজম হাব’ না হলেও তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামে ধরা পড়া বাঘ কলকাতার চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে এখানে রাখা হবে। পুনর্বাসনের প্রশ্ন এড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানান, একশো একর জমি চিহ্নিত করে ঝড়খালিতে ‘মিনি জু’ তৈরি করতে চলেছেন তাঁরা।
শুধু এই দু’টিই নয়, এ দিন অন্তত ২১টি প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু সে টাকা আসবে কোথা থেকে?
মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “আজ যা বলে গেলাম পরে তা হয়ে যাবে।”
বাঘের জন্য বাইসন
বাঘের খিদে মেটাতে সুন্দরবনের ঝড়খালিতে বাইসন আমদানি করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী! অজস্র জলবিভাজিকার আড়ালে সুন্দরবনে জনসংখ্যাও প্রচুর। সেখানে নিত্য বাঘের আনাগোনা। খাদ্যাভাবেই কি বনের বাঘ গ্রামে ঢুকছে? প্রশ্ন তুলে চটজলদি তার সমাধানও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানান, বনশুয়োরের ‘চাষ’ করে সাফল্য মিলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ, “উত্তরবঙ্গে প্রচুর বাইসন আছে। সেখান থেকে কিছু বাইসন এনে এখানে বাঘেদের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখতে পারেন।” কিন্তু বাইসন বা গৌর-এর আবাসস্থল তো ম্যানগ্রোভের জঙ্গল নয়! সে যুক্তি শুনছে কে?
পাল্টা অভিজিৎ
ঝড়খালিতে সঙ্গীতশিল্পী অভিজিতের সঙ্গে আলাপচারিতায়
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সামসুল হুদা।
বাবুল সুপ্রিয় ঢুকেছেন নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায়। কুমার শানুও বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তিনি পিছিয়ে থাকেন কী করে? সোমবার ঝড়খালির মঞ্চে তাই বলিউডের আর এক বাঙালি গায়ক অভিজিৎকে এগিয়ে দিলেন মমতা। ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’ হল। অভিজিৎ ধরলেন, ‘তুম দিল কি ধড়কন মে...’। বললেন, “দিদি দেশের ধড়কন। বাংলার ধড়কন।” সঙ্গে সঙ্গে ‘অনুদান’ও পেলেন। মমতার ঘোষণা, সঙ্গীত-মহাসম্মান দেওয়া হবে অভিজিৎকে। পাল্টা সৌজন্যে নিজের দুর্গাপুজোতেও ‘দিদি’কে আমন্ত্রণ জানান তিনি।
ঘুম ভাঙতে দেরি
কাজের সুযোগ তৈরিতে যে শিল্পের হাত ধরতেই হবে, দেরিতে হলেও তা মানলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঝড়খালিতে বললেন, “শিল্পমহলের বন্ধুদের এনেছি। আগামী দিনে ওঁরা এখানে আসবেন। লগ্নি করবেন। স্থানীয় মানুষের কাছে অনুরোধ, ওঁদের সহযোগিতা করবেন।” বলেন, ‘বাইরের’ লোকের সঙ্গে ‘স্থানীয় লোক’ও লাগবে। মমতার কথায়, “আপনারা এখানেই কাজ পাবেন।” শিল্পমহলে ইতিউতি প্রশ্ন, তবে কি বিলম্বিত বোধোদয়? জমি-জট, সিন্ডিকেট, তোলাবাজিতে নাজেহাল শিল্পের দমবন্ধ দশা কাটাতেই কি সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy