চলছে প্রশিক্ষণ। —নিজস্ব চিত্র।
এইচ, নি, সান, সি। তালে তালে ক্ষিপ্র গতিতে হাত আর পায়ে বিভিন্ন মুদ্রা করে চলেছেন এক তরুণী। পরণে ক্যারাটের চিরাচরিত সাদা পোশাক। কোমরে ব্লু বেল্ট। নাম ঝুমা বাগদি। ঝুমার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অনুসরণ করে হাত পা ছুঁড়ছে কয়েকটি কিশোরী। সিউড়ি ১ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম আড়ালিডাঙায় দেখা গেল এই ছবি।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহেই এই গ্রামে বসে ক্যারাটে শিক্ষার আসর। শিক্ষিকা ঝুমা নিজে একটি পরিবারে পরিচারিকার কাজ করেন। আর তাঁর ছাত্রী পদ্মাবতী অঙ্কুর, সুস্মিতা দলুইরা ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। প্রত্যেকে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে এসেছে। সবাই জানাল, নিজেদের সম্মান আর নিরাপত্তা নিজেরাই বুঝে নিতে প্রস্তুত তারা।
প্রাচীন মার্শাল আর্ট ক্যারাটের প্রতি ইদানিং মানুষের ঝোঁক বেড়েছে। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে জাপানের রিউকু প্রদেশে চিনা মার্শাল আর্টের প্রভাবে ক্যারাটের জন্ম হয়। জেলার ক্যারাটে প্রশিক্ষক অলোক চট্টোপাধ্যায়, অভিজিত লেটদের দাবি, আত্মরক্ষার পাশাপাশি শারীর এবং মন সতেজ, সুস্থ রাখতে ক্যারাটের অনুশীলন কাজে আসে। তাঁরা জানান, জেলার মেয়েদের মধ্যেও ক্যারাটে শেখার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। স্কুলে স্কুলে ক্যারাটে শেখানোর উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে জেলার ক্যারাটে প্রশিক্ষকদের দাবি।
কিন্তু আগ্রহ বাড়ার পিছনে আসলে রয়েছে ক্যারাটে শেখার তাগিদ। সারা দেশ জুড়ে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে মেয়েদের আত্মরক্ষার প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় বীরভূম জেলা প্রশাসন। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত আগস্ট মাসে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওয়ায় স্কুলের মেয়েদের ক্যারাটে শেখানো শুরু হবে। রাজ্য সরকার সেই পরিকল্পনাটির অনুমোদন দেয়। জেলার ব্লক এবং পুরসভা এলাকায় ৩০টি স্কুল নির্বাচন করে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেই স্কুলগুলির প্রতিটিতেই এখন গড়ে ৫০ থেকে ৭০ জন ছাত্রী ক্যারাটে শেখে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে ২০১৩ সালে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা শাসক (উন্নয়ন) কৃষ্ণা মাড্ডির উদ্যোগে এবং সর্বশিক্ষা মিশনের আর্থিক সহায়তায় জেলার ৪০টি স্কুলের প্রায় ২০০০ মেয়েকে ক্যারাটে শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অর্থের অভাবে প্রকল্পটি বেশি দিন চালানো যায়নি। কিন্তু আত্মরক্ষায় ক্যারাটে যে যুতসই একটি উপায় তা ছাত্রী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের নজরে আসে।
ক্যারাটের কিও কুশিন শৈলীতে থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া অলোকবাবু ১৯৯৪ সাল থেকেই জেলার ছেলে মেয়েদের ক্যারাটে শিখিয়ে আসছেন। তিনি জানান, হালে ক্যারাটে শেখায় আগ্রহ অনেক বেড়েছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলের পড়ুয়াদের সেই সুযোগ মেলে। বাদবাকি স্কুলগুলির অনেক ছাত্রীরা ক্যারাটে শিখতে চেয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে অলকবাবুর দাবি। এই প্রসঙ্গে কন্যাশ্রী প্রকল্পের জেলা আধিকারিক মৌসুমী পাত্র জানান, সব স্কুলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি বটে, কিন্তু নির্বাচিত স্কুলগুলিকে নোডাল স্কুল হিসাবে ধরা হয়েছে। ওই স্কুলগুলিতে অন্য স্কুলের মেয়েরাও প্রশিক্ষণ নিতে পারে। তবে প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য এবং আরও বেশি স্কুলকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করা হবে বলে জানান মৌসুমীদেবী।
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জেলার মেয়েদের ক্যারাটে শেখাতে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। সিউড়ির এমনই একটি সংগঠনের কর্ণধার অনন্ত পাল জানান, প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন আর ইভ টিজিং-এর ভয় পায় না মেয়েরা। নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেরাই নিতে শিখেছে তারা। তবে শুধু নিরাপত্তাই নয়, নিয়মিত তালিম নিয়ে গত ডিসেম্বরে মাসে হুগলির ধনিয়াখালি ক্যারাটে ওয়েলফেয়ার সোসাইটি আয়োজিত জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা থেকে পদক জিতে এনেছে জেলার ১৭ জন লড়াকু। সিউড়ি সদর মহকুমা শাসক অরুন্ধতী ভৌমিকের পাঁচ বছরের মেয়েও ক্যারাটে শিখতে ভর্তি হয়েছে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে। অরুন্ধতীদেবী জানান, তাঁর মেয়ের মানসিক জোর বেড়ে গিয়েছে ক্যারাটে শিখতে শুরু করার পর থেকে। যে স্কুলগুলিতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে তার শিক্ষক শিক্ষিকারাও বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী।
তবে, ক্যারাটে শিক্ষার হাতে গরম ফলাফলের উদাহরণ পাওয়া গেল উজ্জ্বল রায়ের থেকে। ঝুমা বাগদি যে শিবিরে প্রশিক্ষণ দেন, উজ্জ্বলবাবু তার আয়োজক সংস্থার কর্ণধার। তিনি জানান, গ্রামের কয়েকটি পরিবারের কর্তারা দাপটের সঙ্গে তাঁদের শাসন চালাতেন। পান থেকে চুন খসলে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেও বিশেষ দ্বিধা করতেন না। মেয়েদের ক্যারাটে শিখতে দেখে ইদানিং তাঁরা একে বারে মিইয়ে গিয়েছেন।
(সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy