কাঠের বেঞ্চে লিকার চায়ের গ্লাসটা ঠক করে রেখে, বৃদ্ধ দোকানি বললেন, ‘‘আজ বড্ড গরম হাওয়া বইছে, আরও ক’দিন বইবে মনে হচ্ছে।’’
ভোটের হাওয়া কোন দিকে বইছে?— প্রশ্ন শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন উনুনের দিকে। কয়লার আঁচের তেজ বাড়াতে পাখা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘‘হাওয়া যে দিকে ছিল, সে দিকেই বইছে। তবে গতি হয়তো এ বারে একটু কমবে।’’
বাদু রোডের ধারের ওই চায়ের দোকানির মন্তব্য শুনে স্মিত হাসলেন বারাসতের ‘ডাক্তার দিদি’। সকালে রাজারহাটে প্রচার সেরে দুপুরে বাদুর দিগবেড়িয়ার বাড়িতে ফিরে কিছু ক্ষণের বিরতি। সেখানে বসে কথা বলার সময়েই তিনি বললেন, ‘‘বারাসত আজ থেকে দশ বছর আগে কী ছিল, আর আজ কী হয়েছে— পার্থক্যটা দেখলেই বোঝা যায়। রাস্তা চওড়া করা থেকে, আন্ডারপাস তৈরি, হাসপাতালের উন্নয়ন, ছোট-বড় সব ধরনের কাজই করেছি।’’ আর তাই উন্নয়নের জোয়ারে এ বারেও ভোট বৈতরণী পার হওয়াটা শক্ত হবে না বলে মনে করছেন বারাসতের দু’বারের সাংসদ তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কেন্দ্র এক নজরে বারাসত
• মোট ভোটার: ১৭,১৫,৯৮৮
• ২০১৪-র লোকসভা ভোটে তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার জয়ী হন। ব্যবধান ছিল ১,৭৩,১৪১
• ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে ফলের নিরিখে হাবড়া, অশোকনগর, রাজারহাট-নিউটাউন, বিধাননগর, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, দেগঙ্গা—এই সাতটি কেন্দ্রে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল।
কিন্তু কিঞ্চিৎ ‘টেনশন’ও রয়েছে। কাকলি বললেন, ‘‘আসলে নিজেদের পায়ের তলার জমি খুইয়ে অলিগলিতে সিপিএম এখন সকলকে বোঝাচ্ছে বিজেপি-কে ভোট দিতে। তবে নিজের রাজনৈতিক চেতনা ও মানবসেবার বোধ থেকেই আমি সব কিছু কাটিয়ে উঠতে পারব।’’ এর বাইরেও আরও একটি কাঁটা বিঁধছে কাকলির চলার পথে। তিনি নিজেই যাকে ‘ঘরের শত্রু’ বলছেন। পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল রাজারহাট-নিউটাউন ও বিধাননগর বিধানসভায়। ২০১৪ এর লোকসভা ভোটে বিধাননগরে এগিয়ে ছিল বিজেপি। যদিও দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে সেই কেন্দ্রে সুজিত বসু ৪৫.৭৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু সময় যত এগিয়েছে রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক তথা বিধানগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের সঙ্গে সুজিত কিংবা কাকলির সুবিদিত ‘সম্পর্ক’ ততই বেআব্রু হচ্ছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও এ নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে। এ বারের লোকসভা ভোটেও কাকলির হয়ে সব্যসাচী এবং তাঁর অনুগামীদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। সূত্রের খবর, সব্যসাচীকে যেটুকু দেখা যাচ্ছে তা মূলত পাশের দমদম কেন্দ্রের প্রচারে। প্রকারান্তরে সমস্যার কথা মানছেন কাকলি নিজেও। তাঁর কথায়, ‘‘ঘর শত্রু বিভীষণ থাকলে তো একটু সতর্ক থাকতেই হয়। তবে কেউ কিছু করতে পারবে না।’’
বিদায়ী সাংসদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সম্পর্কে কোনও রাখঢাক না রেখেই সব্যসাচী বললেন, ‘‘মানুষ ভোট দেবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত উন্নয়ন যখন করেছেন, আর কাকলিদি-ও দু’বারের সাংসদ, ১০ বছরে তিনিও যদি এত উন্নয়ন করে থাকেন তা হলে টেনশনের কী আছে? সব্যসাচী দত্তের তো একটা ভোট। আর উনি ভাবছেন কেন আমি ওঁকে ভোট দেব না। এটা ভাবাটাও তো ভুল।’’ কাকলির ভোট প্রচারে তাঁকে তেমন ভাবে দেখা না যাওয়ার প্রসঙ্গে সব্যসাচীর মন্তব্য: ‘‘কাকলিদির নিজের সংগঠন আছে। আর ২০১৬ সালের আমার বিধানসভা নির্বাচনে সাংসদকে কোথাও দেখা গিয়েছিল কি?’’
তবে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক এ বারেও ‘দিদি’-র হাত শক্ত করবে বলেই মনে করছেন বারাসতের তৃণমূল নেতৃত্ব। এই লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে দেগঙ্গাতে। ৭০ শতাংশের বেশি সেই ভোট এ বারেও কাকলির ঝুলিতে যাবে বলে আশাবাদী সকলেই। দেগঙ্গার শাসক দলের নেতারা বলছেন, ‘‘মোদীর হাত থেকে বাঁচতে গেলে তো দিদির হাত ধরতেই হবে।’’ ২০১৪-তে লোকসভা ভোটে দেগঙ্গা বিধানসভায় বিজেপির থেকে প্রায় ৫৫ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৬ এর বিধানসভা ভোটেও এই কেন্দ্রে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৫১.২৯ শতাংশ।
দেগঙ্গার দাঁড়িপাল্লায় তৃণমূলের ‘ওজন’ বেশি থাকলেও এলাকায় উন্নয়ন নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ, সাংসদ তহবিলের টাকায় উন্নয়ন বেশি হয়েছে শহরে। দেগঙ্গায় এখনও পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হয়নি, অনেক রাস্তাঘাটও বেহাল। বিজেপি প্রার্থী চিকিৎসক মৃণালকান্তি দেবনাথ বলেন, ‘‘দেগঙ্গার কিছু সংখ্যালঘু ভোট আমরাও পাব।’’ ভোট পাওয়ার আশা করছে ফরোর্য়াড ব্লকও। প্রার্থী হরিপদ বিশ্বাসের চিফ ইলেকশন এজেন্ট তথা বারাসতের প্রাক্তন উপ পুরপ্রধান সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, বামেদের পুরনো ভোটের মতো সংখ্যালঘু ভোটও তাঁদের দিকে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সঙ্গে শক্তি হিসেবে রয়েছে রাজারহাট এলাকার মতুয়া ভোট এবং মধ্যমগ্রামের আংশিক ও বারাসত কলোনি এলাকার উদ্বাস্তু ভোটও।
দেগঙ্গার মতোই বারাসত লোকসভার আরও ছ’টি বিধানসভা রয়েছে শাসক দলের হাতে। ২০১৬-তে সাতটি বিধানসভা মিলিয়ে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৫০.১৪ শতাংশ। যা বাম-কংগ্রেসের জোটের থেকে ১২.৯৮ শতাংশ এবং বিজেপির থেকে ৪০.২৬ শতাংশ বেশি। লোকসভা ভোটেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে
বলে দাবি করে তৃণমূল নেতৃত্ব জানান, গত পাঁচ বছরে সাংসদ তহবিলের টাকায় অনেক উন্নয়নের কাজ হয়েছে বারাসত কেন্দ্রে।
২৬ বছর আগে রাজ্য প্রথম পদ্মফুল ফুটেছিল হাবড়া পুরসভায়। ১৯৯৯ সালে উপনির্বাচনে অশোকনগরে জয় এসেছিল বিজেপির। সেই সমীকরণে এ বারেও ওই দুই বিধানসভায় মোদী হাওয়া বইছে বলেই দাবি করলেন হাবড়ার বিজেপি নেতা বিপ্লব হালদার। বললেন, ‘‘হাবড়া, অশোকনগরের পঞ্চায়েত এলাকায় কী ভাবে ভোট লুঠ হয়েছিল, তা মানুষ জানেন। সেই বিষয়টিও এ বারে প্রভাব ফেলবে।’’ যদিও বারাসত পুরসভার উপ পুরপ্রধান অশনি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর কাকলিদি-র নিজস্ব ইমেজ এই দু’য়ের মেলবন্ধনেই তিনি ফের জয়ী হবেন। ও সব হাওয়া কিছু নয়।’’
বারাসতের ইতিউতি দেওয়াল লেখা, ব্যানার, পতাকা ছাড়া তেমন ভাবে অবশ্য চোখে পড়েনি কংগ্রেসের সুব্রতা দত্তের প্রচার। তাই সব মিলিয়ে আসল লড়াই শেষ পর্যন্ত ফুলের সঙ্গে ফুলের। জোড়া এবং একা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy