গড়বেতায় যন্ত্রের সাহায্যে তোলা হচ্ছে বালি। নিজস্ব চিত্র
নালিশটা জমা পড়েছিল লকডাউন চলাকালীনই।
গড়বেতার বৈধ বালি খাদান মালিকদের একাংশ লিখিত ভাবে অভিযোগ করেছিলেন, খোদ জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের নাম করে তোলাবাজি চলছে। আর তাতে জড়িত স্থানীয় তৃণমূল নেতা অনুপ কুমার ওরফে বাচ্চু।
জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের দফতরে এই অভিযোগ জমা পড়ায় শোরগোল পড়ে। অভিযোগ যায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও। তড়িঘড়ি জেলা জুড়ে অভিযানে আটক হয় বালি বোঝাই গোটা চল্লিশেক লরি। জেলাশাসক রশ্মি কমল ও জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার দু’জনেই বলছেন, ‘‘বেআইনি বালি খাদানে আরও কড়া নজরদারি চালানো হবে।’’ আর অনুপের দাবি, ‘‘সব মিথ্যা অভিযোগ। আমার বালির ব্যবসা নেই। আমি জনপ্রতিনিধি। ওরা অবৈধ ভাবে ব্যবসা করে। মেশিন দিয়ে যথেচ্ছ বালি তোলে, পাচার করে। আমি প্রতিবাদ করি। তাই আমার উপরে এত রাগ।’’
পশ্চিম মেদিনীপুর জুড়েই রয়েছে বালি ও মোরাম খাদান। মূলত কংসাবতী, শিলাবতী এবং সুবর্ণরেখার আশপাশে এই সব খাদান থেকে বেআইনি ভাবে বালি ও মোরাম পাচারের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। কোটি কোটি টাকার বেআইনি কারবার চলে বলে অভিযোগ। বিপুল রাজস্বের লোকসান হয়। এই জেলা থেকে বছরে ৬০-৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে ভূমি দফতর। জানা যাচ্ছে, এর বাইরে বেআইনি বালির কারবার চলে, তা থেকে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। কিন্তু সেই টাকা সরকারের ঘরে ঢুকছে না।
বেআইনি বালি পাচারে যুক্ত গাড়ি আটক করেও মোটা টাকা জরিমানা আদায় করে ভূমি দফতর। অনুমতি ছাড়াই বালি বহন করছে, অথবা বাড়তি বালি নিচ্ছে, এই দু’ক্ষেত্রেই জরিমানা আদায় করা হয়। ২০১৯-’২০ তে বালি থেকে জরিমানা আদায়ে জেলায় প্রথম স্থানে ছিল গড়বেতা। জরিমানা বাবদ ৪১ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা আদায় হয়েছিল। গড়বেতার পাশ দিয়ে বইছে শিলাবতী। এখানে ১৩টি বৈধ খাদান রয়েছে। আরও অন্তত ১৬টি অবৈধ খাদান থেকে যথেচ্ছ বালি তোলা হয়, সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই নদীর বুক থেকে যন্ত্র দিয়ে তোলা হয় বালি, বিনা বাধায় পাচার হয় ‘ক্যারিং অর্ডার’ (সিও) ছাড়াই। অতিরিক্ত বালি বোঝাই গাড়ির চলাচলে ভাঙে রাস্তা। ক্ষোভ বাড়ে স্থানীয়দের।
অভিযোগকারী বৈধ খাদান মালিকদের দাবি, ‘দুষ্টচক্রে’র দাপট চলছে এলাকায়। তাঁদের অভিযোগপত্রে হিসেব দিয়ে দাবি করা হয়েছে, গত বছর ১২ মাসের মধ্যে ৯ মাসেই প্রায় ৮ কোটি টাকার তোলাবাজি হয়েছে। দিনে গড়বেতার বিভিন্ন খাদান থেকে ২০০-২৫০ লরি বালি যায়। ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারির পরে প্রথম তিন মাসে লরি পিছু ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। পরের তিন মাসে লরি পিছু ৯০০ টাকা ও পরবর্তী তিন মাসে লরি পিছু অঙ্কটা বেড়ে হয়েছে ২,৩০০ টাকা। সব মিলিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত ৬ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা তোলা আদায় হয়েছে। আরও নানাভাবে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়েছে। অভিযোগকারীদের অন্যতম প্রশান্ত কারক বলেন, ‘‘তোলাবাজি বেড়েই চলেছে। তদন্ত হলে সব স্পষ্ট হবে।’’
গত লোকসভা ভোটে গড়বেতায় তৃণমূলের খারাপ ফলের পিছনে যে দলের একাংশের বালি-কারবারে যোগসাজশ অন্যতম কারণ, তা দলীয় পর্যালোচনায় উঠে এসেছিল। বেআইনি বালি খাদানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের পরে মেদিনীপুরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু লোক আর মাফিয়া এ সব করছে। এ সব করা যাবে না।’’ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকেও বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘কেউ বলেনি আপনাকে বালি খাদানে যুক্ত হতে। আমাদের দল, নেত্রী কখনও বলেননি।’’
এ সব কড়া বার্তার পরেও বালি-চক্রের দাপট কমেনি। আর অভিযোগের আঙুল সেই অনুপের দিকে। গড়বেতা-১ পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ অনুপ তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির ব্লক সভাপতিও। রাধানগরে পেল্লায় বাড়ি তাঁর। রাজ্যে পালাবদলের পরে সিপিএম নেতা জিতেন নন্দী, গণেশ দুলে খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল অনুপের। গণেশ খুনের ঘটনায় জডিত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কিছু দিন জেলেও ছিলেন। পরে জামিন পেয়েছেন। অভিযোগ, গড়বেতার বিশাল বালি-সাম্রাজ্যের অন্যতম ‘নিয়ন্ত্রক’ তিনিই। রীতিমতো কুপন ছাপিয়ে তোলা আদায় করেন।
দল সূত্রে খবর, লোকসভায় গড়বেতায় খারাপ ফলের পর সেখানকার তৃণমূল বিধায়ক আশিস চক্রবর্তীকে ৩-৪ জনের সঙ্গত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই দলে অনুপ ছিলেন। এর পর কিছু দিন চুপচাপ ছিলেন অনুপ। তাঁকে দলীয় কর্মসূচিতে তেমন দেখা যেত না। পরে স্বমহিমায় ফিরেছেন। তবে অনুপকে নিজের ঘনিষ্ঠ বলে মানতে নারাজ গড়বেতার বিধায়ক আশিস। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে। আবারও করা হবে।’’ এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি বলছেন, ‘‘দলের কেউ এ সবে জড়িত থাকলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy