রাস্তায় বসে রাত জাগছেন নেতারা। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে কি? পৌঁছনো যাচ্ছে দলেরই সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের কাছে? পরপর দু’বছর কলকাতার রাজপথে দু’রাত্তির-তিন দিনের ধর্না-অবস্থান কর্মসূচির পরে এমন প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বামফ্রন্টের অন্দরেই!
রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে তাঁবু ফেলে চলতি সপ্তাহের গোড়াতেই তিন দিনের অবস্থানে বসেছিলেন বিমান বসুরা। এ বারের বিষয় ছিল আগামী ২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে জনমত তৈরি করা। গত বছরও এই ভাবেই একই জায়গায় রাত-দিনের ধর্না ছিল বিমানবাবুদের। সে বারের কর্মসূচি ছিল বাম নেতা-কর্মীদের উপরে শাসক দলের হামলা এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রতিবাদে। তবে গত বারের সঙ্গে এ বারের ধর্নার ফারাক মূলত দু’জায়গায়। প্রথমত, এ বার আর শুধু বামফ্রন্ট নয়। মোট ১৭টি বাম দল সামিল হয়েছিল ধর্নায়। এবং দ্বিতীয়ত, ধর্না-অবস্থান ঘিরে বামেদেরই সব অংশের তেমন উত্তেজনা-উৎসাহ ছিল না!
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ বার এক বেলার জন্যও ধর্না-মঞ্চে যাননি। সিপিএমের একাংশের বক্তব্য, ১৭টি বাম দলের জোট নিয়ে তাঁর কিছু ভিন্ন মত আছে। তা ছাড়া, বিগত কিছু দিন ধরে তিনি বিকাল বেলা দ্বিতীয় দফার জন্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দলের সদর দফতরেও আসছেন না। বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতি যেমন জল্পনা বাড়িয়েছে, তেমনই সিপিএম-সহ ১৭টি দলের রাজ্য নেতৃত্ব উপস্থিত থেকেও ধর্না কর্মসূচিকে প্রভাব ফেলার মতো জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। ঘটনাপ্রবাহ দেখে বাম নেতাদেরই কেউ কেউ ঘরোয়া আলোচনায় প্রশ্ন তুলছেন, কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে শুধু রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ বা ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে বসে পড়লেই বিধানসভা ভোটের আগে বামেদের ভেঙে-প়ড়া সংগঠনকে চাঙ্গা করা যাবে কি?
বাম সূত্রের খবর, সম্প্রতি কোচবিহারে একটি কর্মিসভায় বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমানবাবুর উপস্থিতিতেই রানি রাসমণির ধর্নার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ। ধর্না-শিবিরের ছবি দেখে ফ ব-রই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের আক্ষেপ, ‘‘কর্মসূচিতে যাঁরা আসছেন, ঘুরে-ফিরে দেখছি একই মুখ! কর্মসূচিকে আরও অনেক মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া গেল কোথায়?’’ একই ভাবে সিপিএমের এক তরুণ নেতার মন্তব্য, ‘‘বিমানদা, সূর্যদা’দের (রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র) নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু নিচু তলায় যারা লড়াইটা করছে, তাদের কাছে ঠিকমতো বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। রানি রাসমণিতে বসে থেকে সেটা করা সম্ভব নয়।’’ এক বাম বিধায়কও বলছেন, ‘‘রানি রাসমণিতে বিমানদা’রা জেগে থাকলেন না ঘুমিয়ে কাটালেন, তাতে সাধারণ মানুষের কিছু এসে যাচ্ছে না। রাজ্য নেতৃত্ব যখন কলকাতায় অবস্থান করছেন, বুথ স্তরে তেমন কোনও কর্মসূচি কিন্তু হচ্ছে না। ফলে, ফাঁক থেকে যাচ্ছে বিরাট!’’
শ্রমিক, যুব বা ছাত্রের মতো বামেদের নানা গণ-সংগঠনের মধ্যেই একাংশের আক্ষেপ, আম জনতার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্পর্কে ক্ষোভ বাড়ছে। কিন্তু তার ঠিকমতো ফায়দা নেওয়ার মতো মাথা খাটিয়ে কর্মসূচি সাজানো যাচ্ছে না। প্রতীকী কিছু অবস্থান বা জেলাশাসক-পুলিশ সুপারের দফতরে গিয়ে দাবিপত্র দিয়ে আসার মধ্যে জনতাকে আকৃষ্ট করার মতো উপাদান নেই। তার চেয়ে এলাকা ধরে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় চিহ্নিত করে লাগাতার আন্দোলন অনেক বেশি কার্যকর হতো বলে এই অংশের মত। এঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘সারদার মতো দুর্নীতির হাতিয়ার পেয়েও আমরা সেটাকে ধরে রাখতে পেরেছি কি? কখনও সখনও তেড়েফুঁড়ে কর্মসূচি হচ্ছে। বাকি সময়টা শিথিলতা!’’
বিধানসভা ভোটের আগে সাংগঠনিক সক্রিয়তার ছবি যে খুব আশাপ্রদ নয়, বুঝতে পারছে আলিমুদ্দিনও। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, ‘‘বুথ সংগ্রাম কমিটি করে ফেলতে হবে বলে রাজ্য কমিটিতে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য থেকে একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সংগঠনের যতটা আছে, সেটা যাতে খুব সক্রিয় ভাবে কাজ করে, তা দেখা হবে আসন্ন প্লেনামে।’’ সক্রিয়তার নিরিখে দায়িত্ব সাজাতে গিয়ে সংগঠন ছোট হয়ে এলেও ক্ষতি নেই বলে মনে করছে আলিমুদ্দিন।
তবু প্রশ্ন থাকছে, প্লেনামেও কি দাওয়াই বেরোবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy