Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘স্বজন’ চিনে নয়া রেপার্টরি গড়ছে পুরসভা

কারা ‘স্বজন’, কারাই বা ব্রাত্যজন মোটা দাগে সেই সূক্ষ্ম বিচার করে ফেলল কলকাতা পুরসভা। নগরবাসীর করের টাকায় শহরে নাট্যচর্চা কেন্দ্র করতে বাৎসরিক সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দের পুর-ঘোষণা হল সোমবার। নাট্যচর্চা পুর-পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত কি না, সে বিতর্ক আছেই। এ দিন তাকে ছাপিয়ে গেল নাট্যচর্চার বরাত কারা পেল, সেই প্রশ্ন। কারণ পাইকপাড়ার মোহিত মৈত্র মঞ্চে ‘বিনোদিনী রেপার্টরি’ গড়তে নাট্যস্বজন নামে যে সংস্থার হাতে দায়িত্ব যাচ্ছে, তার দুই স্তম্ভ হলেন রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং তৃণমূল সাংসদ অর্পিতা ঘোষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৬
Share: Save:

কারা ‘স্বজন’, কারাই বা ব্রাত্যজন মোটা দাগে সেই সূক্ষ্ম বিচার করে ফেলল কলকাতা পুরসভা।

নগরবাসীর করের টাকায় শহরে নাট্যচর্চা কেন্দ্র করতে বাৎসরিক সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দের পুর-ঘোষণা হল সোমবার। নাট্যচর্চা পুর-পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত কি না, সে বিতর্ক আছেই। এ দিন তাকে ছাপিয়ে গেল নাট্যচর্চার বরাত কারা পেল, সেই প্রশ্ন। কারণ পাইকপাড়ার মোহিত মৈত্র মঞ্চে ‘বিনোদিনী রেপার্টরি’ গড়তে নাট্যস্বজন নামে যে সংস্থার হাতে দায়িত্ব যাচ্ছে, তার দুই স্তম্ভ হলেন রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং তৃণমূল সাংসদ অর্পিতা ঘোষ।

এমনিতে শহরের বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহ সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে পুরসভা। মোহিত মৈত্র মঞ্চ-টাউন হল-স্টার-শরৎ সদন-উত্তম মঞ্চ মিলিয়ে মোট আটটি প্রেক্ষাগৃহ রক্ষণাবেক্ষণের ভার পুরসভার। কিন্তু পুরসভা এখন সরাসরি নাট্যচর্চাতেও মন দেবে বলে ঠিক করেছে। কলকাতার বুকে রাজ্য সরকার মিনার্ভা রেপার্টরি কেন্দ্র চালায়। এ বার কলকাতা পুরসভাও রেপার্টরি গড়তে এগিয়ে আসছে। পাইকপাড়ার মঞ্চটিকে কেন্দ্র করে রেপার্টরি গড়ার কথা কয়েক মাস আগেই ঘোষণা করেছিল পুরসভা। গত বছর অক্টোবর মাসে পাইকপাড়ার মোহিত মৈত্র মঞ্চকে ঘিরে রেপার্টরি তৈরির জন্য দরপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। নাট্যস্বজন সংস্থা যে ওই রেপার্টরির ভার পাচ্ছে, ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল তার পরেই। সোমবার পুরভবনে মোহিত মৈত্র মঞ্চকে নাট্যচর্চা কেন্দ্র হিসেবে নাট্যস্বজনের হেফাজতে দেওয়ার চুক্তি আনুষ্ঠানিক ভাবে সই করল পুর প্রশাসন।

মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারের বক্তব্য, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনেই নাট্যস্বজনকে ওই রেপার্টরির ভার দেওয়া হয়েছে। আরও চার পাঁচটি সংস্থা দরপত্রের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্রের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি নাট্যস্বজনকে তার মধ্যে থেকে বেছে নেয়। মেয়র পারিষদের বক্তব্য, কোন নাট্যসংস্থার রেপার্টরি চালানোর উপযুক্ত উৎকর্ষ রয়েছে, তা বিচার করার ভার ছিল মনোজবাবুর। আর সবচেয়ে কম টাকা কারা নেবে, সেই আর্থিক দিকটি বিচার করার ভার ছিল পুরসভার। দু’দিক থেকেই নাট্যস্বজন শর্ত পূরণ করেছে। মনোজবাবুও জানান, “নাট্যস্বজন সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ওখানে ব্রাত্য আছেন বলে দেশবিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের আনতে পারবেন। তাই আমি ওদের আবেদনে টিক মেরে পুরসভাকে দিই। বাকি সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে।” আপাতত স্থির রয়েছে নতুন রেপার্টরিতে শাঁওলী মিত্রের পরিচালনায় ‘চাঁদ বণিকের পালা’ অভিনীত হবে বছর খানেক, সপ্তাহে এক দিন করে।

যুক্তি যাই হোক, প্রশ্ন নানা মহলে। নাট্যস্বজনের মাথায় রয়েছেন শাসক দলের দুই মুখ ব্রাত্য বসু এবং অর্পিতা ঘোষ। সে ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচালনাধীন সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দিয়ে পুরসভা কি স্বজনপোষণের পথে হাঁটল? প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের কথায় রয়েছে সেই খোঁচা। তিনি বলেন, “এ তো ব্রাত্য বসুদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার কৌশল!” তাঁর মতে, নাট্যচর্চা পুরসভার এক্তিয়ার নয়। পুর আইনে বলা আছে কিছু পরিষেবা দেওয়া বাধ্যতামূলক, কিছু প্রয়োজনভিত্তিক। এর কোনওটাতেই নাট্যচর্চা পড়ে না। বিকাশবাবুর কথায়, “এ ধরনের খরচ অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক এবং পুর-স্বার্থবিরোধী। ক্রিমিনাল অফেন্সও।” নাট্যকর্মী কৌশিক সেনেরও মন্তব্য, “যে সংস্থার হাতে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার নেতৃত্ব অরাজনৈতিক নন। এ সব নিয়ে ভান করার কোনও মানে হয় না। এই প্রবণতা আশঙ্কাজনক।”

এ দিন পুরভবনে চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানে নাট্যস্বজনের পক্ষে ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ, অনীশ ঘোষ এবং পুর-প্রশাসনের পক্ষে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার-সহ পুরকর্তারা হাজির ছিলেন। নাট্যস্বজনকে রেপার্টরির বরাত দেওয়ার প্রক্রিয়া অরাজনৈতিক কি না, সে প্রশ্ন করা হলে ব্রাত্যবাবু বলেন, “রাজ্য সরকারে থাকা আর পুরসভায় থাকা তো এক নয়। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনেই কাজ হয়েছে। আমার বা অর্পিতার নাটকের পরিচয় ছাপিয়ে রাজনীতির পরিচয় বড় করে দেখা হলে কিছু বলার নেই।”

অর্পিতার বক্তব্য, “আমি বা ব্রাত্য বিনোদিনী রেপার্টরির বিষয়ে কোনও সইসাবুদ করিনি। নাট্যস্বজনের পক্ষে সই করেছেন অন্যরা। প্রভাব খাটানোর প্রশ্ন তা হলে উঠছে কেন?” মেয়র অবশ্য এ দিন সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যেই বলে ফেলেন, “ব্রাত্য-অর্পিতারা বহু দিন ধরেই এটা চাইছিলেন। ওঁরা আছেন, কাজ ভালই হবে।”

শোভনবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, রাস্তাঘাট সারাই, নিকাশি, জঞ্জাল অপসারণের মতো পুর-পরিষেবা পাওয়ার জন্য পুর-প্রশাসনকে কর দেন পুরবাসী। সেই টাকায় হঠাৎ নাট্যচর্চাকেন্দ্র করা হবে কেন? মেয়রের উত্তর, “রাস্তাঘাট, নিকাশির কাজ দেখার পাশাপাশি নাট্যচর্চাও আমাদের অগ্রাধিকার। কারণ কলকাতা হল সংস্কৃতির পীঠস্থান।”

পুর-পরিষেবা পাওয়ার জন্য পুরবাসীর থেকে নেওয়া কর কি এ ভাবে ব্যবহার করা যায়? জবাবে মেয়র বলেন, “করা যায়। আমার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে তো দিচ্ছি না। কলকাতা পুরসভা থেকে দিচ্ছি।” মেয়র পারিষদ দেবাশিসবাবুর সংযোজন, “শহরের সংস্কৃতির প্রতি এ আমাদের দায়বদ্ধতা।”

কিন্তু সংস্কৃতির অঙ্গনে পুরসভার যেটা প্রাথমিক দায়িত্ব, সেটা কি ঠিক মতো পালিত হচ্ছে? মোহিত মৈত্র মঞ্চ সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ২৫ লক্ষ টাকা কি পুরসভা দিয়েছে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ দেবাশিসবাবু বলেন, “নিশ্চয়ই দেওয়া হবে। গত আর্থিক বছরে এই মঞ্চ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা আয় হয়েছে। তাই টাকার অভাব হবে না।” সে ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ না করে আগেই রেপার্টরিকে টাকা দিয়ে দেওয়া কি ঠিক হল? তিনি বলেন, “টাকা তো দেওয়া হবে তিন মাস পরে। দেখুন না কী হয়!”

কিন্তু মিনার্ভা রেপার্টরি থাকা সত্ত্বেও শহরে নতুন করে আর একটা রেপার্টরি করার দরকারই বা হল কেন? মিনার্ভায় এক সময় ‘রাজা লিয়রে’র মতো মঞ্চসফল নাটকের পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় এ দিন নতুন রেপার্টরির খবর শুনে বলেন, “আমি স্তম্ভিত। সব কেমন ধাঁধার মতো। আমার কিছু বলার নেই।” অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মিনার্ভাকে কেন্দ্র করে জলঘোলা নাট্যজগতের ‘আমরা-ওরা’ শিবির বিভাজন আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল। তার পর থেকে মিনার্ভা এখনও অবধি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছে। অনেকেরই তাই অভিমত, এ বার কোনও রকম ‘ঝুঁকি’ এড়াতে সরাসরি ব্রাত্য-অর্পিতাদের হাতেই নতুন রেপার্টরি তুলে দেওয়া হল। যাতে গোটা ব্যবস্থাটাই থাকে ‘স্বজন’-সঙ্গে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE