পুরভোটের আগে ফের ‘বদান্যতা’ পুরসভার।
এ বার লক্ষ্য ব্যবসায়ীদের মন জয়। তাই অগ্নিবিধি না-মানার কারণে পাঁচ বছর ধরে আটকে রাখা ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম ‘শিথিল’ করল কলকাতা পুর-প্রশাসন। আর সেই পথ ধরেই শহরের প্রায় ৪৩ হাজার দোকান-মালিক ট্রেড লাইসেন্স ফের পুনর্নবীকরণ করতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে ঠিক হয়েছে, অগ্নিবিধি মানা হবে, এই মুচলেকাটুকু দিলেই দাহ্য পদার্থ থাকে এমন দোকানে এক বছরের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে। আর অন্য দোকানের ক্ষেত্রে তা-ও দিতে হবে না। এই সিদ্ধান্তে কার্যত অনেকটা স্বস্তি পেলেন ওই দোকান-মালিকেরা।
ব্যবসায়ী মহলে পুরসভা এবং দমকলের ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই নানা ধরনের ক্ষোভ জমেছিল। সরকার এবং তৃণমূলের উপর তলায় তা পৌঁছেও যায়। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শহরে বিজেপি-র উত্থান। কলকাতার ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ অবাঙালি। এখানে বিজেপি-র উত্থানের পিছনে তাঁদের ভূমিকাও তৃণমূল নেতৃত্বের অজানা নয়। এই অবস্থায় ভোটের আগে ব্যবসায়ীকুলের ‘স্বার্থ’ রক্ষা করতেই তৃণমূল-শাসিত পুরসভার এমন মরিয়া চেষ্টা বলে অনেকের মত। যদিও মেয়রের মতে, এটা ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ।
দিন কয়েক আগে শহরবাসীর মন জয়ে কর মকুবের ‘টোপ’ দিয়ে আরও একটি প্রস্তাব নিয়েছে পুরবোর্ড। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বাসিন্দা তাঁর নিজের বাড়ির বাইরের রং নীল-সাদা করলে, তাঁকে এক বছরের সম্পত্তিকর দিতে হবে না। বিরোধীদের কথায়, পুরভোট যত এগিয়ে আসছে, পুরবোর্ড ততই ভোটারদের কাছে ‘উদার’ হওয়ার জন্য এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পুরসভায় বিজেপি-র নেত্রী মীনাদেবী পুরোহিত বলেন, “সামনে পুরভোট, ওঁরা আতঙ্কে ভুগছেন। তাই ব্যবসায়ীদের টোপ দিচ্ছেন।”
কেন লাইসেন্স আটকে রাখা হয়েছিল? পুরসভা সূত্রের খবর, বছর পাঁচ-ছয় আগে নন্দরাম মার্কেট এবং স্টিফেন কোর্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে শহরের ৪২টি বহুতল এবং সেখানে থাকা দোকানগুলি অগ্নিবিধি মেনে চলছে কি না তা দেখার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গড়ে সরকার। সেই কমিটিতে দমকল, পুলিশ, সিইএসসি এবং পুরসভার পদস্থ অফিসারেরা ছিলেন। ওই কমিটি বিভিন্ন বিল্ডিং ঘুরে রিপোর্ট দেয়। তার ভিত্তিতেই ওই দোকানগুলির লাইসেন্স নবীকরণ বন্ধ রাখা হয়। কমিটির নির্দেশ ছিল, অগ্নিবিধি না মানা হলে লাইসেন্স নবীকরণ করা যাবে না। গত পাঁচ বছর ধরে এ ভাবেই চলেছে। মাঝে মধ্যে বিল্ডিংগুলি পরিদর্শনেও যান তাঁরা। তবে কয়েকটি বাদ দিয়ে অধিকাংশ বিল্ডিংয়ে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক ভাবে করা হয়নি বলেই জানিয়েছেন দমকল দফতরের একাধিক কর্তা। যদিও ওই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক বার পুর-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে লাইসেন্স নবীকরণের জন্য তদ্বিরও করেন দোকান-মালিকেরা। পুরসভা সূত্রের খবর, ওই সব দোকানের লাইসেন্স নবীকরণ না হওয়ার জন্য প্রতি বছর প্রায় ১৬ কোটি টাকা করে আয় কম হয়েছে পুরসভার। চলতি বছরের শেষে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। বড়বাজারের রাজাকাটরা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তাপস মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের বাজার বহু পুরনো। কমিটির নির্দেশ মেনে অগ্নি-নিরাপত্তায় কিছু কাজ করেছি। সব করা যে সম্ভব নয়, তা জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পুরসভায় গিয়ে দরবার করেছি। ফল মেলেনি।”
পুরসভা সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার পুলিশ, সিইএসসি, দমকল ও পুরসভার অফিসারদের নিয়েই ওই বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ওই ৪৩ হাজার দোকানের লাইসেন্স নবীকরণ করা হবে। যাঁরা দাহ্য জিনিসপত্র নিয়ে ব্যবসা করেন (দমকল দফতরের হিসেবে ১৩টি ব্যবসা ওই তালিকায় রয়েছে), তাঁদের লাইসেন্স দেওয়ার বেলায় শর্ত থাকবে তিন মাসের মধ্যে দোকানের অগ্নি-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দোকানের ক্ষেত্রে নবীকরণ করা হবে সাধারণ ভাবেই।
স্বভাবতই পুরসভার অন্দরমহলে এ নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে। পুরসভার তিন নম্বর বরো চেয়ারম্যান সিপিএমের রাজীব বিশ্বাস বলেন, “অগ্নিবিধি মানার আগেই লাইসেন্স নবীকরণ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এতে তো যে কোনও সময় বিপদ হতে পারে” তাঁর প্রশ্ন, “শর্তের তিন মাসের মধ্যে কোনও অঘটন ঘটলে তার দায় কে নেবে?” পুরসভায় কংগ্রেসের নেত্রী মালা রায় বলেন, “ভয়ানক সিদ্ধান্ত। এমনটা হলে তো কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকবে না।”
ক্ষুব্ধ পুরসভা ও দমকলের একাধিক অফিসারও। তাঁদের মতে, যে সিদ্ধান্ত এ দিন নেওয়া হল তা তো অনেক আগেই নেওয়া যেত। পাঁচ বছর অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল না। তাঁদের কথায়, যে কারণের জন্য তা আটকে রাখা হয়েছিল সব ক্ষেত্রে তো তা পূরণ হয়নি।
তা হলে নবীকরণ করা হচ্ছে কেন? এ বিষয়ে অবশ্য কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি বৈঠকে হাজির কোনও পদাধিকারীর কাছে। তবে এক পুর অফিসার বলেন, “এটা তো পুরবোর্ডের নীতিগত সিদ্ধান্ত। আমাদের কিছু করার নেই।” দমকলমন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খান বলেন, “কিছু কিছু বিল্ডিংয়ে নির্দেশ মতো কাজ হয়েছে। তবে সবাইকে তা করতে বলা হয়েছে। আপাতত এক বছরের জন্য ওঁদের লাইসেন্স নবীকরণ করা হচ্ছে।” তিনি জানান, বকেয়া টাকা ওঁরা নিশ্চয়ই মিটিয়ে দেবে। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অনেক দিন ধরে লাইসেন্স নবীকরণের দাবি জানিয়েছেন ওঁরা। নিয়ম মেনেই তা করা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy