জল নিয়ে এক চিলতে প্রশংসা। তাতেও কি না জল!
চাহিদা ছাপিয়েই জল সরবরাহ করছে কলকাতা পুরসভা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এই সার্টিফিকেটের বাস্তবতা নিয়ে এমনই সংশয় তুলেছেন জলবিজ্ঞানীরা। তাঁদের বক্তব্য, যত জলই সরবরাহ হোক না কেন, কলকাতার সর্বত্র সমপরিমাণ জল সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে, জলের অপচয় রোখা গেলে কিংবা ভূগর্ভে জলস্তরের ভারসাম্য রক্ষা করা গেলে তবেই মন্ত্রকের এই প্রশংসাকে সুখবর বলে মনে করা যাবে। আর খোদ যাদের জল জোগায় কলকাতা পুরসভা, সেই বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাও বলছে, বাস্তবে ছবিটা অন্য রকম।
এ শহরের বস্তিগুলিতে জলের জন্য নিত্যদিন লাইন, ঘনঘন বচসা, মাঝেমধ্যে মারামারি প্রায় গা-সওয়া ব্যাপার। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় বাড়িতে যত বেশি সম্ভব জল ধরে রাখাটাই নিয়ম এখানে। পুরসভার সরবরাহ যথেষ্ট না হওয়ায় পূর্ব ও দক্ষিণ কলকাতায় আবার অধিকাংশ বহুতলই গভীর নলকূপ বসিয়ে জল তুলছে। কারণ তাদের সে সাধ্য আছে। বাকিদের ভরসা জেরিক্যানের কেনা জল।
এর মধ্যেও কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সম্প্রতি সংসদে পেশ করা এক রিপোর্টে বলেছে, কলকাতায় চাহিদা পূরণ করার পরেও ১ শতাংশ বেশি জল সরবরাহ করা হচ্ছে। নয়াদিল্লি সরবরাহ করছে ২৪ শতাংশ কম, মুম্বই ১৭ শতাংশ কম। দেশের ৩২টি বড় শহরের মধ্যে মুম্বই এবং দিল্লিতে যেখানে পানীয় জলের জন্য ব্যাপক হাহাকার, সেখানে প্রয়োজনের থেকে বেশি জল জোগানোর জন্য কলকাতা পুরসভার প্রশংসা করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। শহরের বস্তি এলাকায় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের ওই রিপোর্টের প্রসঙ্গ তোলা হলে বাসিন্দাদের বেশির ভাগই অবাক হচ্ছেন। জলবিজ্ঞানীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে, কীসের ভিত্তিতে এমন ঢালাও সার্টিফিকেট?
কলকাতা পুরসভার দাবি, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের নিয়মে প্রতিটি বড় শহরে প্রতিদিন মাথাপিছু ১৫০ লিটার জল সরবরাহ করার কথা। সেই জায়গায় কলকাতা পুরসভা প্রতিদিন মাথাপিছু ২১০ লিটার জল সরবরাহ করছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও পুরসভার তরফে চাহিদার চেয়ে বেশি জল সরবরাহের কথা বলা হলেও এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন জলবিজ্ঞানীদের একাংশ।
তাঁদের মূল আপত্তি দু’টি। এক, পুরসভা সর্বত্র সমান জল পাঠাতে পারে না। ফলে কিছু এলাকায় মানুষ চাহিদা মতো জল পান না। আবার কিছু এলাকায় জলের অপচয় হয়। এই পরিস্থিতিতে বেশি জল জোগানোর কথা বলাটা অর্থহীন। কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হাইজিন ও পাবলিক হেল্থের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অরুণাভ মজুমদার জানাচ্ছেন, কলকাতায় প্রতিদিন ৩৫-৩৬ শতাংশ জল নষ্ট হয়। বস্তি এলাকায় বাড়ির ছাদে বা মাটির নীচে জলাধার না থাকায় জল সংরক্ষণ করা যায় না। তাই সেখানে জনপ্রতি ২১০ লিটারের নিয়ম কখনওই মানা হয় না। বছরভর জলসঙ্কটে ভোগে বস্তিগুলি।
দুই, জলবিজ্ঞানীদের আপত্তি অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভের জল তোলা নিয়েও। কেন্দ্রীয় ভূতল পর্ষদের প্রাক্তন অধিকর্তা জলবিজ্ঞানী শ্যামাপ্রসাদ সিংহরায়ের বক্তব্য, বেশি জল দেওয়ার জন্য প্রশংসা পাচ্ছে পুরসভা। অথচ পুরসভা সর্বত্র সমান ভাবে জল দিতে পারছে না বলেই অনেক জায়গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভের জল তুলতে হচ্ছে। পূর্ব কলকাতায় বাইপাসের ধারে এবং দক্ষিণ কলকাতায় তৈরি হওয়া ও নির্মীয়মাণ বহুতলগুলি গভীর নলকূপ বসিয়ে কত জল তুলে নিচ্ছে, তার হিসেবও নেই পুরসভার কাছে।
শুধু তা-ই নয়, কলকাতা পুরসভা যে জল দেয়, তার পুরোটাও গঙ্গার পরিশোধিত জল নয়। ফলে ভূগর্ভের জল তুলছে তারাও। প্রতি দিন ২৭ কোটি ১০ লক্ষ গ্যালন পরিশোধিত গঙ্গার জল সরবরাহের পাশাপাশি তারা প্রতি দিন ৩ কোটি ৫০ লক্ষ গ্যালন জল তুলছে গভীর নলকূপ দিয়ে। ফলে কলকাতার নীচে জলের স্তর নামছে। মহানগরীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে কার্যত পরিবেশের ভারসাম্যের সঙ্গে আপস করছে পুরসভা। পুরো কলকাতায় গঙ্গার জল পরিশুদ্ধ করে সরবরাহ করতে না পারলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
শ্যামাপ্রসাদবাবু জানাচ্ছেন, “গত দু’দশকে কলকাতার মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ অংশে জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে নেমেছে। কোথাও কোথাও তা ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। পার্ক সার্কাস এলাকায় জলস্তর নেমেছে সব থেকে বেশি। শহরের জল সরবরাহে যে ভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে, তা কলকাতার পরিবেশের পক্ষে মোটেই সুখবর আনছে না।”
কারণ, ভূগর্ভ থেকে অত্যধিক জল তুললে বৃষ্টির জল তা পূরণ করতে পারছে না। রাজ্যের সেচ দফতরের কর্তাদের দাবি, “রাজ্য সরকার গত দু’বছরে ৬১ হাজার পুকুর কেটেছে। খাল তৈরি হয়েছে। মাটিতে জল ধরার ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।”
কিন্তু এই দাবির সঙ্গে একমত নন জলবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, বৃহত্তর কলকাতা ও আশপাশে যে সব পুকুর এবং জলাশয় রয়েছে, সেগুলির জল কিন্তু ভূগর্ভের ভাল জলস্তরে পৌঁছচ্ছে না। মাটির ৮ মিটার নীচে যে কাদামাটির স্তর রয়েছে, তা ভেদ করতে পারছে না জল। সেই জন্যই কলকাতায় বৃষ্টি হলে সে জলও ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে মিশতে পারছে না। সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কলকাতা শহরের মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আশা, “ধাপায় জল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলে ই এম বাইপাসের ধারে বাসিন্দাদের আর মাটির নীচের জল তুলে খেতে হবে না। এতে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ভারসাম্যের বেশ কিছুটা উন্নত হবে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে গঙ্গার পরিশোধিত জল দেওয়া সম্ভব হবে।”
গঙ্গার পরিশোধিত জলই যে পুরোপুরি দূষণমুক্ত, সে ব্যাপারে কলকাতার মানুষও ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছেন। শুক্রবারই পুরসভার ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডের একদল বাসিন্দা স্থানীয় কাউন্সিলরের বাড়ির সামনে গঙ্গার পরিশোধিত জল সরবরাহের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের দাবি, গভীর নলকূপের জল নয়, গঙ্গার জল শোধন করে সরবরাহ করতে হবে তাঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy