টানা পাঁচ দিন ধরে তাপপ্রবাহের জেরে অতিষ্ঠ কলকাতা। মঙ্গলবার এ শহরের তাপমাত্রা ছুঁয়েছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পারদ চড়তে চড়তে শুক্রবার তা ছোঁয় ৪১.২ ডিগ্রি। শনিবারও অবশ্য তাপমাত্রার তেমন কোনও হেরফের হয়নি। এ দিন তা ছিল ৪১.১ ডিগ্রি, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৬ ডিগ্রি বেশি।
আবহাওয়া দফতরের হিসেব অনুযায়ী, মার্চ-এপ্রিল মাসে সাধারণত চার-পাঁচটি কালবৈশাখী হয় এই মহানগরে। কিন্তু এ বার কলকাতার কপালে তা জোটেনি বললেই চলে। কিন্তু বৃষ্টির এই আকালের কারণ কী?
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকেই এর জন্য দায়ী করছেন আবহবিদেরা। সাধারণত, কলকাতা ও লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গে জোলো হাওয়া ঢোকে বঙ্গোপসাগরে উচ্চচাপ বলয় তৈরি হলে। কিন্তু এ বছর তা কোনও ভাবেই তৈরি হচ্ছে না। দিল্লির মৌসম ভবন জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে আসা বায়ুপ্রবাহ (পশ্চিমী ঝঞ্ঝা) উত্তর ভারতে আছড়ে পড়ছে। তারই প্রভাব গিয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের উপরে। অবশ্য আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েছেন, এই উচ্চচাপ তৈরি না হওয়ার পিছনে বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরের নানা পরিবর্তনই দায়ী। কিন্তু কেন সেই বদল এসেছে, সেই রহস্য অবশ্য এখনও ভেদ করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
বস্তুত, কলকাতার তাপপ্রবাহে এত দিন লাগাম টেনেছে বঙ্গোপসাগর। টানা দিন দু’য়েকের পোড়ানো গরমের পরে সাগরের জোলো হাওয়াই কলকাতাবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দিত। কখনও কখনও সেই জলীয় বাষ্পের কারণেই স্থানীয় ভাবে মেঘ তৈরি হত। আর সেই মেঘ থেকে ঝড়বৃষ্টি হওয়ার ফলেও এক ধাক্কায় গরম অনেকটা কমে যেত। কিন্তু হাওয়া অফিসের এক কর্তার কথায়, “জলীয় বাষ্প না থাকার কারণে কলকাতায় এ বার সে ভাবে কালবৈশাখী হতে পারেনি। তার ফলে শহরের তাপমাত্রা লাগাতার বেড়েই গিয়েছে।”
সাধারণত গরমকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি বেশি হলেই তাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়। এপ্রিল-মে মাসে কলকাতায় এই তাপপ্রবাহের ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। বরং প্রতি বছরই এক-দু’দিন তাপপ্রবাহের দেখা মেলে। কিন্তু এ বছর টানা তাপপ্রবাহে যেন সেই নিয়মটাই বদলে গিয়েছে।
মৌসম ভবনের এক বিজ্ঞানীর কথায়, “এত দিন রাঁচি, পানাগড় বা বাঁকুড়ায় যে ধরনের আবহাওয়ার দেখা পাওয়া যেত, এ বার তার দেখা মিলছে কলকাতাতেও।”
এর আগে মহানগরে তাপপ্রবাহের এমন অসহনীয় টানা দাপট দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে। সে বার ১৯ এপ্রিল কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল। অর্থাৎ, আগের বারও লোকসভা ভোটের সময়ে আবহাওয়া কমবেশি এমনই গরম ছিল। কিন্তু এতটা লম্বা ছিল না সেই ইনিংস। সে বার তাপপ্রবাহ চলেছিল মাত্র তিন দিন। এ বছরের মতো টানা পাঁচ দিনের তাপপ্রবাহ আগে কখনও দেখা গিয়েছে কি না, সে তথ্য নেই হাওয়া অফিসের কাছেও। তবে ইতিহাস বলছে, ১৯৫৪ সালের ১৯ এপ্রিল কলকাতার পারদ পৌঁছেছিল ৪৩.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। হাওয়া অফিসের কাছে চড়া গরম হিসেবে শুধু ওই একটি দিনেরই উল্লেখ রয়েছে। তার আগের বা পরের দিনগুলির কোনও বিস্তারিত বিবরণ নেই। ফলে সে সময়ে এমন টানা তাপপ্রবাহ চলেছিল কি না, তা জানার কোনও উপায় নেই।
গরমের এই বাড়বাড়ন্তের প্রসঙ্গে উঠে এসেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রসঙ্গও। লাগাতার দূষণের ফলে দিন-দিন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে, তা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু বদলের কথাও।
প্রশ্ন উঠেছে, এই লাগাতার তাপপ্রবাহ কি তারই ইঙ্গিত? এ বিষয়ে অবশ্য এখনই কোনও রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না আবহবিজ্ঞানীরা। মৌসম ভবনের এক কর্তা বলেন, “এই পরিবর্তন যে বিশ্ব উষ্ণায়নেরই ফল, তা নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে আরও অনেক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।” তবে এই বদল স্থায়ী হলে আগামী বছরগুলিতেও গরমের চরিত্র এমনটাই থাকবে বলে দাবি করেছেন তিনি।
তবে গরমের কারণ যা-ই হোক না কেন, আম-বাঙালির প্রশ্ন, আপাতত এই গরমের হাত থেকে নিস্তার মিলবে কবে?
নিস্তার কবে মিলবে, তা অবশ্য নিশ্চিত ভাবে জানা নেই আলিপুর আবহাওয়া দফতরের কর্তাদেরও। কারণ, বঙ্গোপসাগরে একটি উচ্চচাপ তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত মিললেও উপকূল থেকে তা অনেকটা দূরে। রেডার-চিত্রে ঝড়বৃষ্টির মেঘ তৈরি হওয়ার ইঙ্গিতও মিলেছে। তবে তা কলকাতা বা লাগোয়া জেলায় তেমন উপকারী বন্ধুর ভূমিকা নেবে না বলেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “দক্ষিণবঙ্গে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টির একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা গরম কমাতে সাহায্য করবে না।” হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, আরও অন্তত দিন দু’য়েক এমনই দহনজ্বালা সইতে হতে পারে দক্ষিণবঙ্গবাসীকে।
রৌদ্র রোষ
তারিখ
তাপমাত্রা*
২২ এপ্রিল
২৩ এপ্রিল
২৪ এপ্রিল
২৫ এপ্রিল
২৬ এপ্রিল
৪০.০
৪০.৮
৪১.১
৪১.২
৪১.১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy