ষাটের দশক থেকে আমি অজিতদার সঙ্গে কাজ করেছি গণনাট্য সংঘে। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ দিয়ে শুরু। তার আগে আমি দু’একটা পাড়ার থিয়েটার করেছি। তেমন একটা অভিজ্ঞতা ছিল না। বলা যায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ই আমাকে তৈরি করেছিলেন। এই যে আমি আজ অভিনেত্রী, সেটা ওঁরই কৃতিত্ব। পরে অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি, অনেক কিছু শিখেওছি, কিন্তু অজিতদার কাছে যা শিখেছি তা সারা জীবনের সঞ্চয়। নান্দীকারে থাকার সময় আমি অজিতদার নির্দেশনায় ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ করেছিলাম। এই নাটক দু’টিই ভীষণ বিখ্যাত হয়েছিল। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ তো নান্দীকারকে বিশেষ পরিচিতিও দেয়। তবে এটা ঠিক, নান্দীকার যে আজ নান্দীকার হয়েছে তার পুরো কৃতিত্ব কিন্তু অজিতেশের। তাঁর তৈরি করা ভিতের উপর এখনও দাঁড়িয়ে আছে নাটকের ওই দল। কত অভিনেতা-অভিনেত্রী যে তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজকের অনেক স্বনামধন্য শিল্পী ওঁর হাতে তৈরি। আমাদের দুর্ভাগ্য, বড় অসময়ে চলে গেলেন। আজ মনে হয়, উনি থাকলে বড় ভাল হত। বাংলা থিয়েটার কত ভাল প্রযোজনা দেখতে পেত!
আমি নান্দীকার ছেড়ে দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। অজিতদা ছাড়লেন ’৭৭-এ। সেই সময়ে অসম্ভব চাপে ছিলেন। কিন্তু ওই রকম টালমাটাল অবস্থায় তিনি ‘পাপপুণ্য’ নামালেন। কী অসামান্য বঙ্গীয়করণ! বিদেশি নাটককে এমন ভাবে বাংলার মঞ্চে উপস্থাপন করতেন যেন কোনও মৌলিক বাংলা নাটক। আমি পাঁচটা নাটকে ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি। এবং তার প্রায় সব ক’টিতেই প্রধান চরিত্রে। অজিতদা সব সময় বলতেন, ‘‘অভিনয় নিজে থেকে করতে হয়। শেখানো যায় না। আমি তোমার ভুল ঠিক করে দেব। কিন্তু কাজটা তোমাকেই করতে হবে।” অসম্ভব ধৈর্য ছিল। এক লাইনের একটা ‘অ্যাক্টিং’, এক ঘণ্টা ধরে তুলতেন। চরিত্র বোঝাতেন এমন করে, তাকে জীবন্ত মনে হত। কোনও দিন এক লাইন সংলাপ বলা শিখিয়ে দেননি। বলিয়ে নিয়েছেন। তাতে অনেক সময় লাগত। কিন্তু উনি সে সময়টা দিতেন। এখন তো আমাদের, মানে অভিনেতাদের সময় নেই। নির্দেশকদের সময় নেই। তাড়াতাড়ির যুগ এখন। কাজ করার পদ্ধতিটাই এখন পাল্টে গিয়েছে। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’র সময় মনে আছে, একটা কান্না কিছুতেই আমি পারছিলাম না। রিহার্সালের পর রিহার্সাল হচ্ছে। এক দিন হঠাৎ পেছন থেকে আমায় অজিতদা ধাক্কা দিলেন। আমি পড়ে গেলাম। খুবই অপমানিত বোধ করছি। অজিতদা আমায় বললেন, “মায়া, ওই সংলাপটা বলুন।” আমি তো হাঁ। ওই অবস্থাতেই বললাম সংলাপটা। উনি বললেন, “এই কান্নাটা কোথা থেকে এল? দু’মাস ধরে পারলেন না, আজ কী ভাবে হল?” আমি বললাম, “নিজেকে খুব অপমানিত লাগছিল। তাই কেঁদে ফেলেছি।” অজিতদা তখন আমায় বলেছিলেন, “দেখলেন, অপমানের কান্না কখনও জোরে হয় না! আমি এটাই চাইছিলাম।” এই হচ্ছেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy