পোশাক তৈরির একটি দোকানের ভিতরে বসে কাজ করছিলেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। সেখানে উপস্থিত হল চার তরুণ। কিছুক্ষণ কথা বলার পরে পকেট থেকে বন্দুক বের করে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল এক জন। ওই ব্যক্তি লুটিয়ে পড়তেই এলাকা ছেড়ে চম্পট দিল ওই যুবকেরা।
বৃহস্পতিবার রাতে, তপসিয়া ফার্স্ট লেনের জনবহুল এলাকার একটি পোশাক তৈরির দোকানের ভিতরে ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ জানায়, মৃতের নাম মহম্মদ মুর্শেদ (৪০)। বাড়ি তিলজলা লেনে। তিনি ওই দোকানেই পোশাক তৈরির কাজ করতেন। ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরেই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে গুলি বোমায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ট্যাংরা। দু’দিন পেরোতে না পেরোতেই ফের গুলি চলল তপসিয়া ফার্স্ট লেনে।
পুলিশ জানায়, তিলজলা রোডের বাসিন্দা মহম্মদ মুর্শেদ ওই দোকানে দর্জির কাজ করতেন। ওই রাতেও দোকানে কাজ করছিলেন তিনি। তখন সেখানে আসেন এহসান ফারুক, ওয়াসিম আক্রম, আমির খান এবং মহম্মদ সাজিদ নামে চার যুবক। পুলিশের দাবি, সকলেই মুর্শেদের পূর্ব পরিচিত। দোকানে কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ওই যুবকদের সঙ্গে বচসা শুরু হয় মুর্শেদের। আচমকা পিস্তল বার করে মুর্শেদের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালায় ফারুক। কপালের বাঁ দিকে গুলি লাগে। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় মুর্শেদের।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছে, দুষ্কৃতীরা সকলেই পার্ক স্ট্রিটের একটি পোশাক তৈরির দোকানে কাজ করতেন। মুর্শেদ আগে সেখানেই কাজ করতেন। অভিযুক্তদের কাউকে প্রায় এক লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন মুর্শেদ। সেই টাকা ফেরত চাওয়া নিয়েই ওই যুবকদের সঙ্গে মুর্শেদের বচসা শুরু হয়। পুলিশের অনুমান, এর জেরেই মুর্শেদকে খুন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতেই দোকানের মালিক মহম্মদ আরমান চৌধুরী খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার সকালে পুলিশ গ্রেফতার করে ফারুক, ওয়াসিম আক্রাম ও সাজিদকে। আমির পলাতক। ধৃতদের থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি দেশি বন্দুক।
এ দিন মৃতের শ্যালক সৈয়দ পারভেজ জানান, ঘটনার রাতে ১১টার পরেও মুর্শেদ ফিরছে না দেখে তার মোবাইলে ফোন করেন স্ত্রী শাবানা বেগম। ফোনে পুলিশ তাঁকে জানায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুর্শেদকে।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় এলাকা থমথমে। তপসিয়ার ওই দোকানের দোতলার বাসিন্দা মনসুর আলম অবশ্য দাবি করেছেন, রাতে গুলি চালানোর কোনও আওয়াজ তিনি পাননি। তবে, এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, এমন জনবহুল এলাকায় বাড়িতে ঢুকে গুলি চালানোর ঘটনায় তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।
স্বাভাবিক ভাবেই বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরে ফের প্রশ্নের মুখে শহরের নিরাপত্তা। কখনও দুষ্কৃতীরা দিনদুপুরে বোমাবাজি করছে। কখনও বা গুলিবৃষ্টি চলছে এলাকা দখল ঘিরে। নিচুতলার পুলিশ কর্মীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন দুষ্কৃতীদমনে কলকাতা পুলিশের দক্ষতা নিয়েও।
অনেকেই বলছেন, অপরাধ দমন বৈঠকে পুলিশ কমিশনার বার বার শহর থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিলেও তা যে কার্যত হচ্ছে না, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবারের ঘটনা তা ফের স্পষ্ট করে দিল। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, শীর্ষকর্তারা দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ না দেওয়ায় একের পর এক গুলি চালানোর ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি, দুষ্কৃতীদের ধরার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ শহরের আইন-শৃঙ্খলা অবনতির অন্যতম কারণ বলেও তাঁদের অভিযোগ।
এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠেছে লালবাজারের কর্তাদের ভূমিকা নিয়েও। বন্দর এলাকার একটি থানার এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘কলকাতায় অপরাধ রুখতে আগে থেকেই দুষ্কৃতীদের তালিকা তৈরি করে তাদের গতিবিধির উপরে নজর রাখতে হবে। কারও কথা না শুনেই তাদের গ্রেফতার করতে হবে। উদ্ধার করতে হবে বেআইনি ভাবে জমায়েত করা অস্ত্র।’’
ওই অফিসারের আরও মন্তব্য, ‘‘উর্দিকে আর ভয় পায় না মানুষ। এতে দুষ্কৃতীরাই সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এটা যদি ঠাণ্ডা ঘরে বসে থাকা শীর্ষকর্তারা না বোঝেন তা হলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।’’
উদাহরণ দিয়ে, লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, মেছুয়া-কলাবাগান এলাকায় সম্প্রতি এক দুষ্কৃতী ভরসন্ধ্যায় অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। খবর পেয়ে কয়েক জন পুলিশ অফিসার তাকে ধরতে যান। কিন্তু সেই সময় কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তার নির্দেশ আসে ওই দুষ্কৃতী শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। তাই ধরা যাবে না।
এক গোয়েন্দাকর্তার মন্তব্য, ‘‘উঁচুতলার কর্তারা যদি কথায় এক আর কাজে আর এক হন, তা হলে নীচুতলার অফিসারেরা কোনও দিন দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে বা শহরে অপরাধ রুখতে পারবেন না।’’ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষের কথায়, ‘‘ঘটনা তো ঘটবেই। কিন্তু দেখতে হবে, পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে। অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছে, চার্জশিটও গঠন হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy