Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

সানা, রোজ়িদের ফুটবল-যুদ্ধে ভরসা বাবুনিদারা

ঘাস-ওঠা ন্যাড়া মাঠটায় রংবেরঙের জার্সি আর কালো লেগিংসের দাপাদাপি! পাশেই কলা-ডিম সেদ্ধ, জলের বোতল নিয়ে বসে আছেন ওঁরা।

অনুশীলন: মুরারিপুকুরের নতুন খেলার মাঠে চলছে ফুটবল। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

অনুশীলন: মুরারিপুকুরের নতুন খেলার মাঠে চলছে ফুটবল। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ঘাস-ওঠা ন্যাড়া মাঠটায় রংবেরঙের জার্সি আর কালো লেগিংসের দাপাদাপি! পাশেই কলা-ডিম সেদ্ধ, জলের বোতল নিয়ে বসে আছেন ওঁরা।

রমশা শাকিলকে হাঁফাতে দেখেই কপালে ভাঁজ ভীষ্মদেব কর্মকার ওরফে বাবুনিদা-র। সঙ্গে তেড়ে বকুনি, ‘‘বাড়িতে একটু ছোলা ভেজানো রাখতে পারিস না? কত বার বলেছি, সকালে খালি পেটে মাঠে আসবি না!’’ ডানপিটে চতুর্দশীর ফুটবল প্র্যাক্টিসে অগত্যা সাময়িক ছেদ। ছোট একটা টিফিন-কেক, জল খাইয়ে একটু জিরোনোর পরেই মেয়েকে ফের মাঠে নামার অনুমতি। খুদে ফুটবলার-কন্যেদের ‘দিদি’ সাহিনা জাভেদের চোখজোড়াও তখন চিকচিক করে উঠেছে।

‘‘আমাদের মেয়েদের ফুটবল খেলার গল্প মুখে মুখে ফিরছে ঠিকই, কিন্তু ফুটবলারদের এই যত্ন-ভালবাসার স্বাদ আগে কখনও পাইনি।’’— বলছিলেন সাহিনা। রাজাবাজারের নিম্নবিত্ত মহল্লার মেয়েদের কাছে ফুটবল অবশ্য নিছকই খেলা নয়। ওঁরাই বলেন, ‘ফুটবল হল মেয়েদের নিয়ে চিরকেলে ধারণা ভাঙার প্রতীক।’ রাজাবাজার থেকে কিলোমিটার আড়াই দূরে মুরারিপুকুরের বিখ্যাত ‘বোমার মাঠে’ সেই ফুটবলের রেশ ইদানীং ছড়িয়ে পড়ছে।

অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখের বোমা বাঁধার ইতিহাসের স্মৃতি জড়ানো তল্লাটে বল পড়লেই ধুলো ওড়ে। জনপ্রতিনিধিদের কাছে বার বার দরবার করেও লাভ হয়নি মাঠপ্রেমী স্থানীয় বাসিন্দাদের। রাজাবাজারের পড়শি সাহিনাদের মাঠ-সঙ্কটে তাঁরাই এখন মুশকিল আসান।

শামা পরভিন, বুশরা পরভিনরা বলছিলেন, রাজাবাজারে মেয়েদের ঘরে ঘরে ফুটবল খেলায় অভিভাবকদের উৎসাহ থাকলেও পাড়ার কিছু লোকজনের ‘অসভ্যতা’য় অসুবিধা হচ্ছিল। ২০১৭-র শেষে রাজাবাজারের গুল ময়দানে সাহিনাদের সংগঠনের ডাকে ‘স্পোর্টস মেলায়’ শহরের কাছে-দূরের বিভিন্ন মহল্লার মেয়েরা শামিল হন। তাতে অসভ্যতার মাত্রাও বাড়ে। স্থানীয় এক কিশোরীকে নিত্য কটূক্তির অভিযোগে পাড়ার কয়েক জন যুবককে গ্রেফতারও করে পুলিশ। সাহিনার কথায়, ‘‘চাইলে পাড়ার মাঠ, গুল ময়দান, হৃষিকেশ পার্ক বা সায়েন্স কলেজ তল্লাটেও হয়তো খেলা যেত, কিন্তু ভাল খেলতে মেয়েদের প্র্যাক্টিসের একটা স্থায়ী ঠিকানা খুব দরকার ছিল।’’ সেটা তো মিলেছেই। উল্টে মেয়েদের টিফিন, নতুন বুট-জার্সির জোগানেও ভরসা মুরারিপুকুরের বাবুনিদারা।

ফি রবিবার রাজাবাজারের মেয়েদের ফুটবল প্র্যাক্টিসে কোচ, পাড়ারই ছেলে দানিশ আনসারি। শহুরে গরিবদের জাতীয় ফুটবলে কলকাতার হয়ে সেমিফাইনাল খেলেছেন ২৪ বছরের যুবকটি। কার্ডিফে ‘স্লাম ফুটবল বিশ্বকাপেও’ যাবেন শিগগির। পাড়ার খুদে রোজ়ি, সুফিয়া, সানা, কানিস, মেহউইশদের অফুরান তেজের সঙ্গে পাল্লা দিতে গলদঘর্ম দানিশও। রমশা বল ছিনিয়ে ট্যাক্‌ল করতে সব থেকে মজা পায়। স্ট্রাইকার মেহউইশ ভালবাসে গোল করতে। এই মেয়েদের বাবারা কেউ ইমাম, কেউ বা কণ্ঠে কোরান ধারণকারী হাফেজ়। কারও পেশা হকারি, বা ছোট কাপড় কারখানায় মজদুরি। আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিকের আগেও সাপ্তাহিক ফুটবল-আসর ছাড়তে নারাজ সানা তেহসিন। হেসে বলে, ‘‘মা-ই তো সকালে ঠেলে তুলে মাঠে পাঠায়! মনে-মনে হয়তো নিজেও বল খেলতে চায়।’’

‘‘আগে রাজাবাজারের গুল ময়দানে খেলার সময়ে পাশেই ছেলেদের ম্যাচ থেকে বার বার বল এসে পড়ত। মুরারিপুকুরে প্র্যাক্টিসের সময়ে মাঠে একটা গাড়ি ঢুকলেও সামলায় পাড়ার ছেলেরা।’’—রোজ়ির কণ্ঠে ঝরে পড়ে বিস্ময়। সাহিনাদেরও মত, মেয়েরা প্র্যাক্টিস করে খেলাটা শিখলে পাড়ার দু’চার জনের আপত্তিও হাওয়ায় উড়ে যাবে। টিফিন খাইয়ে খেলুড়েদের অটোয় করে বাড়ি পৌঁছে দিতেও সহায় বাবুনি দা-রা। মধ্য চল্লিশের বাবুনি লাজুক হাসেন, ‘‘আমি নিজেও বড়িশা ক্লাবে লেফ্‌ট ব্যাক খেলতাম। রাজাবাজারের মেয়েরা ভাল খেললে তো সেটা কলকাতারই গর্ব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Football Muslim Girls Stereotypes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE