লকডাউনে স্কুল বন্ধ। মাকে কাগজের মাছ তৈরি করে দেখাচ্ছে মেয়ে। নিজস্ব চিত্র।
লকডাউনে বন্ধ স্কুল। পার্কেও খেলতে আসছে না বন্ধুরা। আঁকা, সাঁতার, গানের ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে যে দেখা হবে তারও উপায় নেই! প্রথম দিকে বাবা-মাকে অতিষ্ট করে তুলেছিল দিয়াশিনী। তবে, এখন আর সে কান্নাকাটি করে না। ঘুম থেকে উঠেই রং-পেনসিল-আঁকার খাতা চাই তার। ঘর-বাড়ি আঁকা হলে, দেওয়ালে সাঁটিয়ে তবেই নিস্তার। কাগজ দিয়ে কী করে মাছ বানাতে হয়, মাকে শিখিয়েই ছাড়বে। এই তার আবদার।
দিয়াশিনী দে পাঠভবনে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। একই স্কুলে মন্তেসারির দ্বিতীয় বিভাগে পড়ে কুঁদঘাটের কৌনিশ দাস। সে দিয়াশিনীর থেকে বয়সেও ছোট। সবে পাঁচে পড়েছে। লকডাউনের মধ্যে ইতিমধ্যে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে ডিম, আলুর খোসা ছাড়ানো রপ্ত করেছে। এমনকি স্যান্ডউইচ বানিয়ে বাবা-মায়ের প্লেটে সাজিয়েও দিচ্ছে ছোট্ট হাতে।
কৌনিশের দাদার কৌস্তব আবার ক্রিকেটার বিরাট কোহালির বড় ভক্ত। সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। লকডাউনে তার মাঠে যাওয়া যাচ্ছে না। বাবা আর ভাইকে নিয়ে ছাদেই বল পেটাচ্ছে ছোট্ট ‘বিরাট’। সময় পেলে ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ছে। মাঝে মাঝে কবিতা আওড়াচ্ছে। স্কুলের সাহিত্যসভায় কবিতার ভিডিয়ো পাঠাবে, তারই এখন প্রস্তুতি চলছে।
কিন্তু লকডাউনের আগেও ওদের জীবন এমনটা ছিল না। গোটা দিনটাই রুটিনে বাধা ছিল। স্কুল থেকে ফুরসত পাওয়ার পর, গান, আঁকার ক্লাস, আবৃত্তি, সাঁতার। ওরা জানতই না, কী ভাবে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়? কী ভাবে কাগজ দিয়ে পাখি, মাছ বানানো যায়? মা টিফিন বক্সে স্যান্ডউইচ দিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। এখন নিজেই তা বানিয়ে নিচ্ছে কৌনিশ। খেলা ছাড়া যে কিছু বুঝত না, সেই কৌস্তব এখন চাঁদের পাহাড়ের কল্পনার জগতে ভেসে রয়েছে।
পড়ুয়াদের উদ্দেশে লেখা শিক্ষিকা শুভা গুপ্তের চিঠি।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় দেশে রেকর্ড আক্রান্ত ২,২৯৩ জন, মৃত আরও ৭১
আরও পড়ুন: রেমডেসিভির কী? আর কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে এই ওষুধ
লকডাউনের মধ্যেও সিলেবাস শেষ করতে পড়াশোনায় ছেদ পড়েনি। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অন-লাইনে পড়াশোনা চালাচ্ছে। জুম-এ ক্লাস হচ্ছে। লকডাউন উঠে গেলে ফের স্কুল চালু। ছেলেমেয়ের রেজাল্ট যাতে খারাপ না হয়, সে জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শিক্ষক থেকে অভিভাবকেরা। তবে এর ব্যতিক্রমও যে নেই। তা নয়। অনেক স্কুল আছে, অভিভাবক আছেন, তাঁরা জীবনের পাঠও গুরুত্ব সহকারে বুঝিয়ে থাকেন সন্তানদের।
যেমন সিলেবাস শেষ করার থেকেও জীবনের মূল্যবোধ শেখানোই এখন জরুরি বলে মনে করছে পাঠভবন। তারা জোর দিচ্ছে সৃজনশীল প্রতিভার দিকেই।
সম্প্রতি পড়ুয়াদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছিলেন পাঠভবনের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা শুভা গুপ্ত। চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, দৈনন্দিন ব্যস্ততার মধ্যে যা লক্ষ করা যেত না, তার সময় এসেছে— ঘরের জানালা দিয়ে গাছ, রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট দেখা। একই ঘরে বাস করা টিকটিকিদের বেঁচে থাকা। প্রতি দিন নিজের অভিজ্ঞতার ডায়েরি লেখা যাতে পারে। গল্প, কবিতা, ছবি আঁকাও যেতে পারে। স্কুলের তরফে যা কাজ দেওয়া হবে, তা প্রতিযোগিতার মতো করে না দেখে চর্চার বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘‘পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সময় আগেও এসেছে। তোমাদের কাছ থেকে অনেক সৃজনশীল উপহার পাব।’’
ওই স্কুলের শিক্ষিক-শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের নানা ধরনের সৃজনশীল কাজের উপরেই জোর দিচ্ছেন। ভিয়িয়োর মাধ্যমে গান গেয়ে পড়ুয়াদের রেওয়াজ করতে বলছেন তাঁরা। ছবি আঁকার ধরন শেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে শুভা গুপ্ত বলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের পড়াশোনার আদর্শেই তো পাঠভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথমে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছিল। তার পর যখন লকডাউন ফের বেড়ে গেল, তার পর আমরা চিন্তা করলাম শিশুরা তো হাঁপিয়ে উঠছে। বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছে না। সে জন্যই আমাদের এই পরিকল্পনা।”
তাঁর দাবি, জুনিয়র এবং সিনিয়র ক্লাসগুলিতে এখন মজার ছলে জীবনের মূল্যবোধ শিখছে, উপলব্ধি করছে পড়ুয়ারা। সাড়াও মিলছে। অনেকেই গান করে ভিডিয়ো পাঠাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। কেউ তবলা বাজাচ্ছে, ছবি একে পাঠাচ্ছে। শুধু তাই নয়, নাটকের দৃশ্যও পাঠাচ্ছে। সাহিত্যসভার জন্য ইতিমধ্যেই অনেকেই ভিডিয়ো পাঠাতে শুরু করেছে। জুনিয়র স্কুলেও একই ভাবে পড়াশোনা চলছে।
লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের জীবনের এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিষয়টির প্রংশসা করেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তাঁর কথায়: “সব শিক্ষারই সঙ্গে জীবনের মূল্যবোধ এবং বিজ্ঞান চেতনা হওয়া উচিত। বইয়ে মুখগুঁজে থাকার উপরে জোর দেওয়া হয়। আমাদের প্রকৃতিপাঠ এবং জীবনপাঠটা খুবই দরকার। চারপাশে যা ঘটে, অনেক সময়েই আমরা লক্ষ্য করি না। করতে দেওয়াও হয় না। ঠিক করে দেওয়া হয়, এইগুলো গুরুত্বপূর্ণ, আর এগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এ ভাবে পড়ুয়াদের ভাবতে শেখানো হচ্ছে, আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
পবিত্রবাবুর মতে, অনেকই জানে না টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে কেমন শব্দ হয়। বিশেষ করে শহরের বাচ্চারা জানে না। কিন্তু গ্রামের শিশুরা জানে। তিনি বলেন, ‘‘জীবনকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে ওদের। জীবনের সঙ্গে জড়িত থাকার চেষ্টা করছে। তা সে কাজের মধ্যে দিয়েই হোক, দেখা অথবা শোনার মধ্যে দিয়ে— এটা খুব জরুরি। এই পরিসর যত বাড়বে, জীবনটা আরও অনেক সমৃদ্ধ হবে ওদের।”
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy