প্রদর্শনীতে দেখা যাবে ইলাহাবাদ থেকে পাওয়া দশম শতকের এই সপ্তমাতৃকা প্যানেলটি। নিজস্ব চিত্র
দেবী দুর্গাকে নিয়ে কাহিনির অন্ত নেই। দুর্গোৎসবে অশুভর বিরুদ্ধে শুভর জয়ের উদ্যাপন যেমন হয়, তেমনই দুর্গা শস্যদায়িনী, তিনি মাতৃমূর্তিরও প্রতিমা। ঠিক কবে থেকে এবং কেমন করে ইতিহাসের হাত ধরে ও নানা অনুভবকে কেন্দ্র করে সেই প্রতিমা একটু একটু করে গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে রয়েছে নানা মত ও ব্যাখ্যা। দেবীর নানা রূপও বহু কাল ধরে প্রচলিত। প্রাচীন কাল থেকেই সেই প্রতিমাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য, আঁকা হয়েছে ছবি। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ দুর্গাপুজো উপলক্ষে তাঁদের নিজস্ব সম্ভার থেকে তারই একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। জাদুঘরের অধিকর্তা অরিজিৎ দত্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘এই প্রদর্শনী শুরু হবে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে। এক মাস চলবে।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপিকা স্বাতী রায় বললেন, ‘‘মূর্তিতত্ত্বে দীর্ঘ কাল ধরে নানা ভাবে রূপ পেয়েছে বর্তমান সময়ের দুর্গা প্রতিমা। সেই ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে গেলে প্রাচীন কাল থেকে কী ভাবে এই ভাস্কর্যগুলির বিবর্তন ঘটেছে, এই প্রদর্শনীতে তার একটা আঁচ পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’’
এই প্রদর্শনীতে থাকছে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া সন্তানসম্ভবা এক মহিলার ভাস্কর্য, ওই একই সময়ের জননী ও সন্তানের যুগল মূর্তি, হরপ্পার এক অলঙ্কার পরিহিতা মহিলা, খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকের লজ্জা-গৌরী, বারাণসী থেকে পাওয়া খ্রিস্টীয় দশম শতকের ভৈরব-সহ সপ্তমাতৃকা প্যানেল, ইলাহাবাদ থেকে পাওয়া খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বালিপাথরের তৈরি অসুরনাশিনী, মথুরা থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির অসুরনাশিনী, গুপ্ত রাজত্বের স্বর্ণমুদ্রায় খোদাই করা সিংবাহিনীর প্রতিকৃতি, বিহার থেকে পাওয়া দশম শতকের দেবী ও তাঁর সন্তানের ভাস্কর্য, ওই একই সময়ের চামুণ্ডা ও চণ্ডী মূর্তি, একাদশ-দ্বাদশ শতকে বারাণসী থেকে প্রাপ্ত দু’টি মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। রয়েছে বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে পাওয়া এক সদ্যোজাতের ভাস্কর্যও।
ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে শশিভূষণ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে যে ভাবে দুর্গাপূজা করি, তাহা সম্ভবত ষোড়শ শতকে প্রচলিত হইয়াছে।’ তিনি লিখছেন, এ সম্বন্ধে প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, আকবরের রাজত্বকালে মনুসংহিতার বঙ্গদেশীয় প্রসিদ্ধ টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পিতা উদয়নারায়ণ যজ্ঞ করতে উৎসাহী হলে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজপণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে দুর্গাপুজোর উপদেশ দেন এবং নিজেই একটি দুর্গাপূজাপদ্ধতি রচনা করেন। শশিভূষণ লিখছেন, ‘তবে খ্রীস্টীয় চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিত কতকগুলি দুর্গাপূজাবিধান পাইতেছি। এই বিধানগুলি মুখ্যতঃ দেবীপুরাণ, দেবীভাগবৎ, কালিকা-পুরাণ, ভবিষ্য-পুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশর-পুরাণ জাতীয় কয়েকখানি উপপুরাণ হইতে সঙ্কলিত।’’
যদিও এই গ্রন্থেই শশিভূষণ স্বামী জগদীশ্বরানন্দের ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে শূলপাণির ‘দুর্গোৎসববিবেক’, ‘বাসন্তীবিবেক’ এবং ‘দুর্গোৎসব-প্রয়োগ’ নামে তিনটি গ্রন্থ পাওয়া যায়, তাঁর সমসাময়িক জীমূতবাহনও তাঁর ‘দুর্গোৎসব-নির্ণয়’ গ্রন্থে মৃন্ময়ী দেবীপুজোর কথা বলেছেন। পঞ্চদশ শতকে মিথিলার স্মার্তপণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘ক্রিয়াচিন্তামণি’ এবং ‘বাসন্তীপূজাপ্রকরণ’ গ্রন্থ দু’টিতে দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা পদ্ধতি বিবৃত করেছেন। বিদ্যাপতির ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা পদ্ধতি রয়েছে। ষোড়শ শতকের স্মৃতিনিবন্ধকার রঘুনন্দন ‘তিথিতত্ত্ব’ গ্রন্থে ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ নামে প্রকরণের কথা বলেছেন। তাঁর ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ নামে একটি মৌলিক গ্রন্থও রয়েছে। রঘুনন্দনের গুরু শ্রীনাথেরও ‘দুর্গোৎসববিবেক’ নামে একটি গ্রন্থ রয়েছে। দেবী প্রতিমার গঠনে এই শাস্ত্রচর্চার ভূমিকাও কম নয়। মূর্তিতেও তার প্রভাব পড়েছে।
দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির এই সুপ্রাচীন আবেগ সব পথকেই ছুঁয়েছে। জাদুঘরের প্রদর্শনীতে তাই থাকছে কালীঘাটের পটচিত্র ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবিও। জাদুঘরের শিক্ষা-অধিকর্তা সায়ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতিও পেয়েছে। তাই আমরা চেয়েছি, ইতিহাসের গবেষক থেকে শুরু করে সকলেই যেন দেবী প্রতিমার এই নানা রূপের সম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy