সুর-সন্ধ্যা: উষার গানে মেতেছেন শ্রোতারা। পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চুম্বনে শেয়ালকাঁটা মেশানো ছিল না। তখন চুমুতে ধুম জ্বর আসত কলকাতার!
রঙিন সন্ধ্যার পার্ক স্ট্রিটে তখন অনায়াসে নেমে আসতেন এলভিস প্রেসলি, হ্যারি বেলাফন্টে, বিট্লস বা কার্পেন্টার ভাইবোনেরা। অর্ধ শতক আগে সবে এই শহরে আসেন শাড়ি পরা, ‘শুদ্ধ শাকাহারী’, গিটারধারিণী এক তন্বী। এই সপ্তাহান্তে শুক্র-শনির নিশিবাসরে যিনি ফের নিজের অতীতের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।
সাবেক ট্রিঙ্কাজ় রেস্তরাঁর ফটোর ফ্রেমে এখন ৩৬৫ দিনই জ্বলজ্বল করেন গিটারধারী তরুণী উষা উত্থুপ। শুক্রবার রাতে উষা যেন নিজের সেই ছবির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর শেষের দু’টি সন্ধ্যা আক্ষরিক অর্থেই ছিল কলকাতার গত জন্মে ফিরে যাওয়া। উষা উত্থুপ, তৎকালীন উষা আইয়ারের কলকাতায় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের অর্ধ শতক পালন করল ট্রিঙ্কাজ়।
‘উষা ফিভার’ ধরতেই লাফিয়ে উঠলেন অধুনা মেক্সিকোবাসী, শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের মেয়ে অনু চৌধুরী! ‘ইউ গিভ মি ফিভার হোয়েন ইউ কিস মি, ফিভার হোয়েন ইউ হোল্ড মি টাইট...’। অনু বললেন, ‘‘আমার প্রথম প্রেম, হাত ধরা, চুমু— সবই তো এখানে!’’ ‘‘শুধু কী তা-ই?’’, তাঁর সঙ্গী, কার্শিয়াঙের ইস্কুল, কলকাতার কলেজের বান্ধবী ষাটোর্ধ্ব ‘তরুণী’রা হেসে গড়িয়ে পড়লেন! ‘‘ভেবো না তখনও স্রেফ ‘অল গার্লস টিম’ নিয়েই আমরা আসতাম এখানে।’’
সে দিন একটা ‘বিয়ার’ বা ‘কোল্ড কফি’ মিলত পাঁচ টাকায়। প্যাম ক্রেন, লুই ব্যাঙ্কসের ব্লু ফক্স বা ম্যাগনোলিয়া, মোক্যাম্বোও তখন সুরের নেশায় পাগল। গান ধরার আগে উষা বললেন, ‘‘এই বাঁ দিকটায় অমিতাভ বচ্চন, কবীর বেদীদের বসতে দেখেছি আর ডান দিকে শর্মিলা-পটৌডি। আমার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া মারকাটারি বরটাকেও এখানেই খুঁজে পেয়েছি।’’
একটু আগে পুরনো বন্ধু দোয়েল সেনকে দেখে ‘দোয়েল, কোয়েল’ বলে যেন নেচে উঠেছিলেন উষা। উষার বর জানি চাকো উত্থুপ তখন চা কোম্পানিতে কর্মরত। তাঁর সহকর্মী ছিলেন দোয়েলের স্বামী। ‘‘তোর বিয়েটা তো আমরাই দিলাম।’’— হেসে ওঠেন দোয়েল। জানিকে দেখা গেল, সেই সময়ের সাক্ষী রিতা ভিমানি, গোংলু দাশগুপ্তদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। উষা বললেন, ‘‘ট্রিঙ্কাজ় আমার মন্দির, মসজিদ, গির্জা। ট্রিঙ্কাজ়ই আমায় চিনিয়েছে, সবার সামনে।’’
উষার গান বাছাইয়ে একযোগে এ কাল-সে কালের হাত ধরাধরি। ‘‘এ বার আমি ‘গ্রামের রাস্তা’ গাইব’’, বাংলায় ঘোষণামাত্র শ্রোতারা চেঁচান জন ডেনভার, কান্ট্রি রোডস! উষা গাইবেন, এ খবর পেয়ে এসেছেন পুণেবাসী দেবদূত ও শর্মিলা মুখোপাধ্যায়। আলিপুরের ৮৮ বছরের বৃদ্ধ বাবা অমৃতলাল শাহকে চেয়ার ছেড়ে নাচতে দেখে তাঁর কন্যা তরুণা সিংহীর বিস্ময়, তুমি ছোটবেলায় কী খেতে গো বাবা! উষাকে শুনবেন বলেই দিল্লি থেকে দু’দিনের জন্য এসেছেন, সে কালে লোরেটোর ছাত্রী তরুণা। জন ডেনভারের গানের মতোই কত জন যেন শিকড়ে ফিরতে চাইছেন।
নীলিমা দত্তের মেয়ে লন্ডনবাসী নিনা টলার সদ্য নিজেদের বাড়ি বিক্রি করেছেন কলকাতায়। দু’দিন বাদে বর্তমান ঠিকানা বিলেতে ফিরবেন। উষার ছোঁয়াচে জেগে উঠল টুকরো টুকরো কসমোপলিটান কলকাতার স্মারক। যাকে ইদানীং খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। উষা কিন্তু শুধু অতীতে আটকে থাকেননি। ‘বাবুজি ধীরে চল না’র প্রেরণার স্প্যানিশ সুর শুনিয়েই ‘কোলাভেরি ডি’ বা ২০১১-র ‘ডার্লিং আঁখো সে’র সুরে মাতিয়েছেন। সাবেক জেমস বন্ড সিনেমার থিম গান থেকে অ্যাডেলের ‘স্কাইফল’ সাজিয়ে দিয়েছেন সুরের নেমন্তন্নে। কানে-গলায় ‘ক’ লেখা গয়না, কলকাতার প্রতীক হয়ে ওঠা উষার মনে পড়ল, ‘‘আমি বছর শেষের রাতেও
ট্রিঙ্কাজ়কে একদা ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গাইয়েছি।’’ রাত ১২টায় ‘মাটিলডা’ বা ‘হাভা নাগিলা’র লোকায়ত মেজাজে একযোগে দুলছে কয়েকটি প্রজন্ম। ৬০ থেকে তিরিশের নারী-বাহিনী রেলগাড়ির কামরা সেজে রেস্তরাঁয় ঘুরছে।
‘‘আমার বাবা ওমপ্রকাশ পুরী ও তাঁর পার্টনার জোশুয়া এলিস চেন্নাইয়ের একটা রেস্তরাঁয় উষাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। উষা সেই প্রথম কলকাতায় এসে পঞ্জাবি চানার স্বাদ পেল। ওর জন্য আলাদা রসমের বন্দোবস্ত থাকত।’’— বলে ওঠেন ট্রিঙ্কাজ় কর্ণধার দীপক পুরী। উষার মেয়ে অঞ্জলি, ছেলে সানিরাও তখন উন্মাদনার ছোঁয়াচে মশগুল। বাম আমলে রেস্তরাঁর চড়া বিনোদন করের ধাক্কায় গান-বাজনা খানিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে পার্ক স্ট্রিটে। ফেসবুকে উষার পুনরাবির্ভাবের গল্প শোনামাত্রই ভরে যায় গোটা রেস্তরাঁ। ভক্তদের আবদারে মঙ্গলবার, পয়লা অক্টোবরের রাতেও ট্রিঙ্কাজ়ে থাকবেন উষা। ফের তরুণী হয়ে উঠবে পার্ক স্ট্রিট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy