দশ বছরের সেই ছেলেটি
স্কুলে, কোচিংয়ে, প্রতিবেশীর বাড়িতে কিংবা ঘরের বাইরে অন্য কোথাও বিকৃত মানসিকতার কেউ শিশুর উপর নির্যাতন করছে কি না তা নিয়ে উগ্বিগ্ন থাকেন প্রিয়জনেরা। কিন্তু নিজের বাড়িতে, এমনকী বাবা-মায়ের কাছেও শিশু কতটা নিরাপদ সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বছর দশেকের এক ছোট্ট ছেলের কাহিনি!
রোগাপাতলা ছেলেটি যখন গড়গড় করে অত্যাচারের বিবরণ দিচ্ছিল তখন শিউরে উঠছিলেন কলকাতা শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যেরা। নিজের বাবা-মা তার উপরে নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ এনেছে ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা ওই বালক। স্কুল ছাড়িয়ে তাকে দিয়ে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, নিয়মিত বুকে-পেটে-মুখে লাথি ঘুঁষি মারা, মাথা ঠুকে দেওয়া, খেতে না দেওয়া, একাধিক বার মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া, সারা রাত ধরে হাত-পা টেপানো— কিছুই বাদ নেই সেই নির্যাতনের তালিকা থেকে। আর সহ্য করতে না পেরে সপ্তাহখানেক আগে পালিয়ে সেলিমপুরে মামাবাড়িতে দাদু-দিদার কাছে চলে গিয়েছিল ছেলেটি। নাতির অবস্থা দেখে তাঁরাই কলকাতা শিশু সুরক্ষা কমিটির (সিডব্লিউসি) কাছে লিখিত অভিযোগ করেন মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে।
প্রথমে কমিটিতে ডেকে পাঠিয়ে ওই শিশু ও তাঁর দাদু দিদিমার থেকে সব শোনেন সদস্যেরা। পরে ৩ ডিসেম্বর ডেকে পাঠানো হয় অভিযুক্ত বাবা-মাকে। সে দিন সিডব্লিউসি-র কোর্টে সকলের সামনেই ছেলেটি জানায়, তাকে আবার বাবা-মার কাছে পাঠালে সে এ বার ছাদ থেকে ঝাঁপ দেবে। তার মা যাবতীয় অভিযোগ ভুয়ো বলে দাবি করলে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে ছেলেটি বলে ওঠে, ‘‘একদম মিথ্যে বলবে না। বাবা বেলন চাকি দিয়ে মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কপালের সামনের চুল টেনে তুলে দিয়েছে। চিমটি কেটে হাতে কালশিটে ফেলেছে। তুমি বাবাকে কিচ্ছু বলোনি। তুমি শুধু সারা দিন মোবাইল নিয়ে থাকো। আমাকে খাটের তলায় শুতে দাও। খেতে দাও না, শীতে গরম জামা দাও না, সারা দিন কাজ করাও, হাত-পা টেপাও। আমি আজ সব বলে দেব। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো না। আমি পড়াশোনা করবো।’’
৩ ডিসেম্বর সিডব্লুউসি নির্দেশ দেয়, ওই ছেলেটি থাকবে তার দাদু-দিদার কাছে। কমিটির চেয়ারপার্সন ইন্দ্রাণী গুহব্রহ্ম ও অন্যতম সদস্য অমিত ভট্টাচার্য জানান, লেক থানার এক পুলিশকর্মীর উপস্থিতিতেই তারা থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে অবিলম্বে তদন্ত শুরু করে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইন্দ্রাণীদেবীর কথায়, ‘‘এমন অত্যাচার নিজের সন্তানের উপরে কেউ করতে পারে!’’
যদিও মঙ্গলবার পর্যন্ত সিডব্লিউসি-র নির্দেশ কার্যকর করেনি পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে লেক থানার ওসি প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্যকে টেলিফোনে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘‘এমন কোনও নির্দেশ সিডব্লিউসি দেয়নি। সিডব্লিউসি-র নির্দেশ নিয়ে ওঁদেরকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমার যা বলার ডিসি-কে বলবো।’’ ডিসি (দক্ষিণ) প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘এমন ঘটনার কথা জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো।’’ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ শিশুটিকে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায় বলে জানা গিয়েছে। তার দাদু-দিদার কথায়, ‘‘সাহস পাচ্ছি না বাচ্চাটাকে বাড়িতে রাখতে। পুলিশ কোনও ভরসা দিচ্ছে না। যে কোনও সময় জামাই ওকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারে।’’
ছেলেটির দাদু আরও বলেন, ‘‘ওদের একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে আছে। তাকে জামাই কিছু করে না। যত রাগ ছেলেটার উপরে। অকথ্য অত্যাচার করে। কত বার যে মেরে মাথা ফাটিয়েছে ঠিক নেই।’’ মঙ্গলবার বিকেলে ছেলেটির বাড়ি গেলে দেখা যায়, দরজায় তালা। ফোনে যোগাযোগ করলে তার মা বলেন, ‘‘বিষয়টি কোর্টে গিয়েছে। আপনাদের মাথা ঘামাতে হবে না। ডিসটার্ব করবেন না।’’
মঙ্গলবার মামাবাড়িতে দিদার কোলে বসে ছেলেটি বলল, ‘‘মা-বাবা সবাইকে বলতো আমি পাগল, তাই স্কুলে ভর্তি করেনি। রাত চারটে পর্যন্ত আমাকে দিয়ে হাত-পা টেপাতো। আবার ভোর সাড়ে ছ’টায় ঘুম থেকে তুলে বাসন মাজাতো। কাজ না করলে বাবা আমাকে মাটিতে ফেলে বুকে পা দিয়ে পিষতো। বিকেলে যখন ওরা বাইরে যেত আমাকে আর চিকুকে চেন দিয়ে বেঁধে রেখে দিত। বাড়িতে মাংস হলে আমাকে শুধু ঝোল দিত।’’ একটু থেমে ছোট্ট ছেলের আর্তি, ‘‘আমার কুকুর চিকুকেও ওরা খুব মারে, খেতে দেয় না। ও একা ওই বাড়িতে রয়েছে। আমি চাই, চিকুকেও যেন পুলিশকাকুরা দিদার বাড়ি এনে দেয়।’’
কলকাতার আরও খবর পড়তে চোখ রাখুন আনন্দবাজারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy