আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মিছিল। সোমবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
মিছিল করে হেঁটে যাচ্ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বুকে লাগানো কালো ব্যাজে লেখা ‘টিচার্স ফর তিলোত্তমা’। ওঁরা হাঁটছেন কলেজ স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজারের দিকে। বিভিন্ন জেলা থেকে আর জি কর-কাণ্ডে নির্যাতিতার বিচার চাইতে সোমবার শহরে এসেছিলেন তাঁরা। সেখানে কারও হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা— ‘আমার ছাত্রী আমার মেয়ে, রাস্তায় তাই বিচার চেয়ে’। কারও প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘আমরা জাতির মেরুদণ্ড, আনব বিচার, পাবেই দণ্ড’।
মিছিলের একটু পিছনের দিকে হাঁটছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা শুক্লা রায়। বললেন, ‘‘মেরুদণ্ড সোজা রাখতে গেলে সৎ হতে হবে, সাহসী হতে হবে। এটাই আমি সারাজীবন আমার ছাত্রীদের শিখিয়েছি।’’ হাঁটতে হাঁটতেই জানালেন, চাকরিজীবনে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সৎ থাকার মাশুল দিতে হয়েছে তাঁকেও। তবু দমে যাননি। শুক্লা জানান, বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সেটা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর। আমি তখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আমার কাছে ফোন এসেছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে, তাঁর রেফারেন্সে এক জনকে স্কুলে ভর্তি নেওয়ার জন্য। আমি রাজি না হওয়ায় উনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি করছেন?’ আমি বলেছিলাম, নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ভর্তি নিলে তবেই দুর্নীতি করব। যে নিয়মে সকলে ভর্তি হয়, সেই নিয়মেই ভর্তি হতে হবে ওই ছাত্রীকে। এর পরেই আমার কাছে বদলির চিঠি আসে। আমাকে কল্যাণীর মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে বদলি করে দেওয়া হয়।’’ অন্যদের সঙ্গে মিছিলে পা মিলিয়েই শুক্লা বলেন, ‘‘ওই স্কুল থেকেই অবসর নিয়েছি। কিন্তু মাথা নোয়াইনি।’’
সৎ থাকার শিক্ষা কী ভাবে পাবে পড়ুয়ারা? খড়দহ থেকে মিছিলে এসে শুক্লা এ দিন বলেন, ‘‘শুধু স্কুল নয়, মা-বাবাকেও শিক্ষা দিতে হবে। ছেলেমেয়ে ফেল করছে, সেখানে তার অভিভাবকেরা স্কুলে এসে পাশ করিয়ে দিতে বলছেন। কী শিক্ষা পাচ্ছে ছেলেমেয়েরা? এখান থেকেই তো অবক্ষয় তৈরি হয়। আর জি করের মতো ঘটনা ঘটে।’’ তাঁর প্রশ্ন,আর জি করে যে ঘুঘুর বাসা, তা কি সরকার জানত না? আগে ব্যবস্থা নিলে হয়তো ওই চিকিৎসক-ছাত্রীকে এভাবে মরতে হত না বলেও দাবি করলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষিকা।
এ দিনের মিছিলে অংশ নেওয়া শর্মিষ্ঠা সেন, চুমকি ভুঁইয়ারা জানালেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের থেকে বাঁচানোর শিক্ষাই পরবর্তী প্রজন্মকে দিচ্ছেন তাঁরা। চুমকি বলেন, ‘‘এ বার দুর্গাপুজোয় উৎসব করার কোনও উৎসাহ নেই। শ্রীভূমির পুজোয় সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পুজোর সময়ে বেশির ভাগ সময়েই বেড়াতে চলে যাই। এ বার তা-ও বন্ধ। ছাত্রীরা প্রতিবার পুজোর আগে কেনাকাটার গল্প করে আমাদের কাছে। এ বার সেই সবও প্রায় নেই। আর জি করের ঘটনা আমাদের মতো পড়ুয়াদেরও ক্ষতবিক্ষত করেছে।’’
আর এক শিক্ষিকা মৌমিতা দত্ত বললেন, ‘‘আমাদের এই মিছিল রাজনৈতিক নয়। আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদের জন্য একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিলাম। একটু একটু করে সেখানে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই গ্রুপের নাম দিয়েছি ‘টিচার্স ফর তিলোত্তমা’। সেই দলটাই আজ পথে নেমেছে।’’ কিন্তু পেশায় তাঁরা স্কুলশিক্ষক, অর্থাৎ সরকারি কর্মী। মিছিল করার কারণে প্রশাসন কুপিত হলে? কয়েক জন শিক্ষিকার কথায়, ‘‘ভয়ের কী আছে? আমরা তো কোনও অন্যায় করছি না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমেছি। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।’’
পায়ে পায়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মিছিল শ্যামবাজারে পৌঁছয়। কয়েক জন শিক্ষক-শিক্ষিকা সেখান থেকে প্রশ্ন তুললেন, হাসপাতাল, থানা তো ভরসার জায়গা। কিন্তু সেখানেই যদি এক চিকিৎসককে এমন নৃশংস ভাবে খুন হয়ে যেতে হয়, তা হলে বাকিদের নিরাপত্তা কোথায়?
মিছিল থেকে তখন স্লোগান উঠেছে, ‘তিলোত্তমার রক্তচোখ, তোমার বুকের আগুন হোক।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy