কারও কথা বলার ধরনে জড়তা এসেছে। কেউ অত্যধিক জেদি হয়ে গিয়েছে। কেউ আবার স্কুলে এসে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সমবয়সি অনেককে দেখে তাদের সঙ্গে খেলা তো দূরে থাক, মিশতেই চাইছে না। উল্টে বাড়ি যাওয়ার বায়না করছে নাগাড়ে।
অতিমারি আবহে গত দু’বছর বন্ধ থাকার পরে অবশেষে রাজ্যে খুলেছে স্কুল। তার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গিয়েছে শহরের অসংখ্য প্রি-স্কুলগুলিও, যেখানে খুদে পড়ুয়াদের বয়স দুই থেকে চার বছররে মধ্যে। প্রি-স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানাচ্ছেন, গত দু’বছরে এই সব স্কুল বন্ধ থাকায় কচিকাঁচাদের অনেকেরই আচরণগত বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এত দিন কচিকাঁচাদের মা-বাবারা তাদের নিয়ে অনলাইন ক্লাসে বসেছেন। কিন্তু স্কুলে এলে ক্লাসে খেলাচ্ছলে পড়াশোনা এবং সেই সঙ্গে শিশুর যে মানসিক বিকাশ ঘটত, তার যেন কোথাও একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
শহরের একটি প্রি-স্কুলের শিক্ষিকা বিদিশা সর্বাধিকারী বলেন, ‘‘গত দু’বছর মা-বাবারা থাকলেও তাঁরা তো সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে ছিলেন না। বাড়ির নানা কাজের সঙ্গে ওয়ার্ক ফ্রম হোমও করেছেন। বাচ্চারা স্কুলে এলে যেমন কয়েক ঘণ্টা শিক্ষকদের নজরে থাকে, বিশেষ প্রশিক্ষণ পায়— সেটা এত দিন হয়নি। উল্টে ওরা কান্নাকাটি করলে মা-বাবারা হয়তো হাতে মোবাইল দিয়ে বা টিভিতে কার্টুন চ্যানেল খুলে দিয়ে ভুলিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন বাড়িতেও সমবয়সি খেলার সঙ্গী পায়নি অধিকাংশ শিশু। তাদের কেউ কেউ স্কুলে একসঙ্গে অনেককে দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছে, এমনও হচ্ছে।’’
কলকাতায় প্রি-স্কুলের বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে, এমন একটি স্কুলের অধ্যক্ষা নীলাক্ষী শুক্লা জানান, তাঁদের স্কুলে সপ্তাহে দু’দিন অফলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘বাচ্চাদের অভিভাবকেরা তাদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী। তবে আমরাই রোজ অফলাইন ক্লাস রাখছি না। আস্তে আস্তে স্কুলে আসায় ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার পরে অফলাইন ক্লাসের সংখ্যা বাড়াব।’’ নীলাক্ষী আরও জানান, দু’বছর ধরে স্কুল বন্ধ থাকার জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে শহরের বহু প্রি-স্কুলও। কারণ সেই সব স্কুলগুলির বেশির ভাগই চলে বাড়ি ভাড়া করে। তাই দু’বছর ধরে বাড়ি ভাড়া দেওয়া অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই প্রি-স্কুলগুলি ফের নতুন করে খোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
শহরের আরও একটি প্রি-স্কুল শাখার অধ্যক্ষা নবনীতা বসু মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁদের প্রি-স্কুলে গত দু’বছর নিয়মিত অনলাইনে পড়াশোনা হয়েছে। মা-বাবারা তাঁদের বাচ্চাদের নিয়েই অনলাইন ক্লাস করেছেন। এতে তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন, ক্লাসে কোথায় তাঁদের সন্তানের খামতি থাকছে। তবে অফলাইন ক্লাসও যে ওই শিশুদের জরুরি, সে কথাও বলছেন তিনি।
ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স আলি চাইল্ডহুড এডুকেশনের চেয়ারম্যান তথা প্রি-স্কুলের পড়াশোনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করা তমাল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দুই থেকে চার বছরের খুদেদের পড়াশোনায় একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। তাই প্রি-স্কুলের পড়ুয়াদের বই-খাতার সঙ্গে ডিজিটাল কনটেন্টও দরকার। ওদের জন্য বিশেষ অ্যাপ, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। কী ভাবে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষকেরা শিশুদের পড়াবেন, তার প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে ডিজিটাল পড়াশোনা করানোর জন্য মা-বাবাকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাতে গত দু’বছরের ঘাটতি দ্রুত পূরণ হবে বলেই আশা রাখছি। শিশুদের ব্যবহারিক পরিবর্তন কত তাড়াতাড়ি শোধরানো যায়, সেটাও খুব জরুরি।’’
তবে ব্যবহারিক পরিবর্তন নিয়ে চিন্তার কারণ দেখছেন না শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রি-স্কুলের শিশুদের আচরণগত কিছু পরিবর্তন হলেও তা স্কুলে যেতে যেতেই ঠিক হয়ে যাবে। দু’-চার বছরের বাচ্চাদের এখন নিয়মিত প্রি-স্কুলে গেলে ক্ষতি নেই। যত তাড়াতাড়ি সব কিছু স্বাভাবিক হয়, ততই ভাল।’’