স্মরণে: সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবস উদ্যাপন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, খিদিরপুরে। নিজস্ব চিত্র
‘স্বাধীনতা কেউ কাউকে দিতে পারে না। তা কেড়ে নিতে হয়।’— পার্ক সার্কাসের মাঠের পোস্টারে তাঁর ছবির নীচে জ্বলজ্বল করছে কথাগুলো। বুধবার সকালে ঠিক সেখানেই তাঁর জন্মদিনে জাতীয় পতাকা তোলা হল।
গার্ডেনরিচ মুদিয়ালি স্কুল মোড়ের কাছে মানববন্ধনে অনেকের সঙ্গে হাত ধরাধরি করা হিজাবধারী তরুণীর গলাতেও ঝুলছে সেই ছবি। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বিরোধী প্রতিবাদেও অস্ত্র হয়ে উঠেছেন সুভাষচন্দ্র বসু। আজকের ভারতে কেন জরুরি সুভাষ-জয়ন্তী উদ্যাপন? গত কয়েক দিন ধরেই গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজের ঘরে-ঘরে বিষয়টি নিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন গার্ডেনরিচ নাগরিক পরিষদের কর্মকর্তারা। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের চোখে ভেদ ছিল না ধর্মে, ধর্মে। ইত্তেহাদ, এতমাদ, কুরবানি (ঐক্য, বিশ্বাস, বলিদান)-র জন্য সংগ্রামে নেমেছিলেন তিনি। আইন করে ধর্মের নামে দেশের নাগরিকদের বিভাজনের প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্রের নাম তাই যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ দিন সকালে দেখা গেল বাঁধাবটতলা থেকে মুদিয়ালি স্কুল মোড়, কাচ্চি সড়ক মোড় থেকে মেটিয়াবুরুজ থানার রাস্তায় মানুষের ঢল। ৪২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে কমল টকিজ়ের দিকেও হাতে হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় মেয়ে, পুরুষ, বাচ্চা, বুড়ো, জোয়ান।
পুরো মানববন্ধনের চেহারাটা কেমন হয়েছে তা দেখতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন পায়ে চোট লাগা এক তরুণী। কিছুটা এগিয়ে বাধ্য হয়ে রিকশায় উঠলেন। গার্ডেনরিচ কাচ্চি সড়কের মোড়ের কাছে নামার সময়ে তাঁর থেকে রিকশাচালক ভাড়া নেবেন না জানিয়ে দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়লেন। ‘অচ্ছে সে নারা লাগাও’! পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদের অন্যতম মুখ রিপন স্ট্রিটের বধূ আসমত জামিল। সুভাষচন্দ্রের ছবি সামনে রেখে তেরঙা উত্তোলনের সময়ে স্লোগান উঠল, শহিদ স্মরণে, জীবনে মরণে নেতাজি তোমায় ভুলব না!
ধর্মতলায় চ্যাপলিন পার্কের কাছে এনআরসি-বিরোধী যুক্ত মঞ্চের অবস্থানেও দিনভর সুভাষচন্দ্রের ছায়া। তাঁদের কর্মকর্তা দেবর্ষি চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘সুভাষচন্দ্রের ভাবনায় দেশে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরম্পরা বহন করার প্রাসঙ্গিকতা এখন আরও বেশি। গার্ডেনরিচের মানববন্ধনের অন্যতম আহ্বায়ক কুশল দেবনাথের কথায়, ‘‘এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে সুভাষ-স্মরণের তাগিদটা এ বার আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।’’ টিকিয়াপাড়া, রামনগর লেন মসজিদের মৌলানারা প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। সাইবার কাফের মালিক হামিদ রশিদ, ডাক্তারবাবু রমেন্দ্রনাথ পাল, স্বাস্থ্যকর্মী রুকসানা বেগম, জিইসি কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক জালালুদ্দিনরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘এক ছিলাম, এক আছি, এক থাকব’। পার্ক সার্কাসের মাঠেও গত কয়েক দিন ধরে যেমন স্লোগান উঠেছে, ‘ফ্যাসিবাদ কে ছাতি পর, গাঁধী, সুভাষ, অম্বেডকর’।
দেশের ইতিহাসের এই পর্বে স্বাধীনতা-সংগ্রামের নায়কদের অনেকের নাম একযোগে উঠে আসাটা তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকছে ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের চোখেও। রজতবাবুর কথায়, ‘‘এমনিতে গাঁধী, সুভাষদের পথে অমিলও যথেষ্ট। কিন্তু হিন্দু, মুসলিমের ঐক্যসাধন বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীনতায় তাঁদের ১০০ ভাগ মিল। আজকের প্রতিবাদীরা যাঁদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন সেই বিজেপি-শিবিরের রাজনীতিটাই আবার হিন্দু, মুসলিমের ভেদ ঘটানো। তাই ঠিক সময়েই এক নিঃশ্বাসে গাঁধী-সুভাষদের নাম উঠে আসছে।’’
কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও আগে গাঁধীর ঢঙে চরকা কাটতে বা নেতাজি-টুপি পরে ছবি তুলতে দেখা গিয়েছে। রজতবাবুর চোখে, ‘‘এগুলো রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বামপন্থীদের সঙ্গেও সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গেরুয়া-শিবিরের আদর্শের কোনও মিলই নেই।’’ এখনকার কোনও রাজনৈতিক শিবিরই অবশ্য
সুভাষ বা গাঁধীর পরম্পরার যথার্থ অনুসারী নন বলেই মনে করেন রজতবাবু। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ার কথা বলতে সাধারণ নাগরিক বা নেতারা গাঁধী, সুভাষের কাছে প্রেরণা খুঁজবেন এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy