মা কেমন হয় রে টুসিদিদি?
মা? মা হল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। যে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, সব বিপদ থেকে আগলে রাখে, ভুল করলে বকে, শাসন করে, আবার দুঃখ পেলে কাছে টেনে নেয়। বুঝলি?
কই? আমি তো দেখতে পাই না?
বা রে, কেন পাবি না? দুগ্গা ঠাকুর তো সব্বার মা। চার পাশে পুজোর এত এত হোর্ডিংয়ে দেখছিস না? এই যে এক-একটা পুজোয় দুগ্গা ঠাকুর এক এক রকম, সে তো মায়ের মতোই। কোথাও রাগী, কোথাও আবার খুব শান্তির।
তুই স-অ-ব হোর্ডিং দেখেছিস টুসিদিদি?
দেখেছি তো! ওই যে সে দিন বাজারে গেলাম, তখন।
জানিস বনি, মা যেমন করে বাড়ির সব্বাইকে আগলে রাখে, উল্টোডাঙার সিআইটি লাইটস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর পুজোতেও দেবী দুর্গা গোটা প্রকৃতিকে রক্ষা করছেন। ওদের এ বার থিম ‘পঞ্চতত্ত্ব’। মানে প্রকৃতির পাঁচটা রূপ মেঘ, সূর্য, জল, মাটি, পৃথিবী রয়েছে মণ্ডপে ঢোকার মুখে। তাদের রক্ষা করছেন শান্তির প্রতীক মা দুর্গা। বুদ্ধমূর্তির আদলে মায়ের প্রশান্ত মুখ।
আসলে বাড়িতে মা-রাই তো দশ হাতে সব সামলে রাখে। বাড়ির সবার ভাল থাকা, রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব কিছু। সংসারে কোনও রকম খারাপ হলে প্রবল শক্তিতে মা-ই তা দমন করে। গৌরীবাড়ি এলাকার হালসীবাগান সর্বজনীনের পুজোয় এ বার মা দুর্গা ঠিক ও রকমই। দশমহাবিদ্যা মানে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশ দেবীর মিলিত শক্তিতে মা দুর্গা সব অশুভ শক্তিকে দমন করবেন। সেই শুভ শক্তির তেজে গলে জল হয়ে যাবে মহিষাসুরের অশুভ শক্তি। অথচ দেখবি মায়ের হাতে অস্ত্র নেই। কোনও হাতে সূর্য, কোনওটায় ধান। বাড়ির সবাইকে ভাল রাখতে হবে তো!
কখনও আবার দুষ্টু লোকদের শাসন করতে গিয়ে মা বড্ড রেগে যায়। সুরেন সরকার রোডের নব জাগ্রত সঙ্ঘে মা তাই রুদ্ররূপিণী। বৃত্তাকার মণ্ডপে পৃথিবীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবে অসুর। কিছুটা নটরাজের মতো ভঙ্গীতে প্রবল রাগে ত্রিশূল ছুড়ে তাকে দমন করবেন মা দুর্গা। তাঁর চারপাশে সূর্যশক্তির ছটা।
তবে মা-রাই তো আমাদের সব কিছু শেখায়, পড়াশোনা থেকে ভাল মানুষ হওয়া সবই। তাই দুষ্টু লোকেদেরও অনেক সময়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে-বুঝিয়ে ভাল করে তুলতে চায়। বাঁশদ্রোণীর রায়নগর উন্নয়ন সমিতিতে যেমন সমাজের সব অশুভশক্তিকে জ্ঞানের শক্তিতেই দমন করবেন মা। মণ্ডপসজ্জায় তাই থাকবে দেবনাগরী লিপি, সূর্যের শক্তি, আয়নায় প্রতিবিম্ব থেকে তৈরি হওয়া শক্তি। মণ্ডপটাও হবে সূর্যের ছটার আদলে। মায়ের মুখে থাকবে অপার শান্তি।
মায়ের কাছ থেকে এমন শিক্ষা পেয়েই ভাল-মন্দ চিন্তার, বোঝার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। চেতনা জাগে। ভিআইপি রোড এলাকায় গোলাঘাটা সম্মিলনীর পুজোয় সেই চেতনা জাগারই গল্প। সেকালের ভাঙাচোরা ইটের বাড়ির মতো মণ্ডপ আসলে দীর্ঘদিনের জমে থাকা মলিন ভাবনা। উঁচু উঁচু থাম মানুষের দম্ভ। চেতনায় আলোর দিশা দিতে পাঁচিলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবেন মা দুর্গা।
জানিস বনি, যারা খারাপ থেকে আবার ভাল-র পথে পা বাড়ায় তারা কিন্তু মায়ের কাছে গিয়েই নিজেদের সব খারাপগুলিকে বিসর্জন দিয়ে আসে। ঠিক সে ভাবেই এ বার বাগুইআটি তালতলার আমরা সবাই ক্লাবের থিম ‘সমর্পণ’। মানুষের জীবনের সব ভাল-মন্দের উৎস তো আসলে ষড় রিপু। এখানে কাল্পনিক মন্দিরের মতো মণ্ডপে তাই মা দুর্গার পায়েই অসুররূপী ষড় রিপু সমর্পণ করবে দানবাকৃতি অসুর।
মা দুগ্গার জীবনটা কি শুধুই ফ্যামিলি?
দূর বোকা, আরও কত কী আছে! মা দুর্গাও আগে সতী ছিলেন। তার পরে শিবের স্ত্রী পার্বতী হলেন। ট্যাংরা ঘোলপাড়া সর্বজনীন এর পুরোটাই তুলে ধরেছে তাদের পুজোয়। সতীর শিব আরাধনা, স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রণহীন শিবের জন্য দুঃখপ্রকাশ, আত্মাহূতি, শিবের প্রলয়নৃত্য, সতীর দেহ খণ্ডিত হয়ে ৫১ পীঠ সৃষ্টি, পার্বতীর জন্ম, শিব সাধনা, শিবের বরদান, শিব-পার্বতীর বিয়ে এবং গোটা পরিবারের সৃষ্টি সবই থাকছে সেখানে। থাকবে সমুদ্র মন্থনের গল্পও। জানিস, সব কিছুই দেখানো হবে কালো হিরে অর্থাৎ কয়লার কারুকাজে।
আচ্ছা টুসিদিদি, আমার মা কই?
বা রে, ওই যে বললাম, মা দুগ্গাই আমাদের সব্বার মা!
পাঁচ বছর আর ন’বছরের গল্পে-গল্পে রাত নিঝুম। অনাথ আশ্রমের আঁধার ঘরে জড়িয়ে আসে চোখের পাতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy