বড়তলা থানার সামনে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ অমিত আব্রাহাম। সোমবার রাতে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
অধ্যক্ষকে ফিরিয়ে আনতে চেয়ে রাস্তা জুড়ে অনশনে বসে পড়লেন পড়ুয়ারা।
অনশন তুলে নিতে অনুরোধ করলেন পদত্যাগী অধ্যক্ষই।
তবু পড়ুয়ারা অনশন না-তোলায় অধ্যক্ষ সটান হাজির হলেন থানায়। পুলিশকর্মীদের অনুরোধ করলেন, ‘গ্রেফতার করুন আমাকে’!
সোমবার স্কটিশ চার্চ কলেজের এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহে হতবাক হয়ে যান পুলিশকর্মীরাও। তবে তাঁরা অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করেননি।
শনিবার থেকেই স্কটিশ চার্চের অধ্যক্ষ-পদে অমিত আব্রাহামের ইস্তফা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে। মেধা-তালিকায় নাম না-থাকা সত্ত্বেও কাউন্সেলিংয়ে ডাক পেয়ে অনেকে কলেজে ভর্তি হচ্ছেন বলে অভিযোগ। এই অনিয়মকে কেন্দ্র করেই পদত্যাগ করেন অধ্যক্ষ। কলেজ সূত্রের খবর, দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়েই এই পথ বেছে নেন তিনি। ২২ অগস্ট তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি বিশপ অশোক বিশ্বাসের কাছে। তাঁর পদত্যাগ মানতে পারছেন না কলেজের শিক্ষক-পড়ুয়াদের একাংশ। অধ্যক্ষকে ফিরিয়ে আনতে সোমবার অনশনে বসেন কলেজের সাত পড়ুয়া। কিন্তু অধ্যক্ষ অনড়। সন্ধ্যায় অমিতবাবু নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যান বড়তলা থানায়। কেন?
অমিতবাবু জানান, অনশন তুলে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য তিনি পড়ুয়াদের অনুরোধ করেন। কিন্তু পড়ুয়ারা নারাজ। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে তাঁরা রাস্তা অবরোধ করেন। তার পরেই থানা থেকে ফোন যায় অমিতবাবুর কাছে। পুলিশকর্তারা তাঁকে জানান, পড়ুয়ারা রাস্তায় বসে পড়ায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি যেন পড়ুয়াদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেন। অমিতবাবুর কথায়, তিনি পড়ুয়াদের বারবার বোঝানো সত্ত্বেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। পড়ুয়ারা রাস্তায় বসেই অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান। তার পরেই অমিতবাবু সোজা চলে যান থানায়। তিনি বলেন, ‘‘কলেজ এবং কলেজের বাইরের এই পরিস্থিতির জন্য আমিই দায়ী। সেই জন্যই গ্রেফতার হতে এসেছি। এই ঘটনায় আমার সম্মানহানি হয়েছে।’’
পুলিশ অবশ্য জানায়, অমিতবাবু তাদের কাছে ও-কথা বলেননি। ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ীও করেননি। শুধু জানান, পড়ুয়াদের বোঝাতে তিনি অপারগ। থানা থেকে বেরিয়েই তিনি চলে যান স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনে, যেখানে রাস্তায় বসে ছিলেন পড়ুয়ারা। রাত প্রায় ৯টা নাগাদ তিনি পড়ুয়াদের ফের বোঝাতে শুরু করেন। পড়ুয়ারা জানান, তাঁরা এ দিনের মতো অনশন তুলে নিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ কাজে না-ফিরলে মঙ্গলবার থেকে তাঁরা আবার অনশনে বসবেন। অমিতবাবু অবশ্য তাঁদের বলেন, ‘‘তোমাদের ভালবাসাকে সেলাম। কিন্তু আমার কাছে আমার সম্মানই আগে। আমি ফিরে আসব না। এলে আমার লাশ আসবে।’’
নাটকের শুরু সকালে। কলেজের টিএমসিপি-র পক্ষ থেকে অধ্যক্ষের পদত্যাগের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ দেখান কিছু পড়ুয়া। অনশনে বসা কলেজের ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক তৃণমূলের অভিষেক রায় বলেন, ‘‘অধ্যক্ষ সব সময়েই আমাদের সাহায্য করেছেন। আমরা ওঁকে ফিরে পেতে চাই। তাই অনশন। ওঁকে অনুরোধ, সিদ্ধান্ত বদলান।’’
অধ্যক্ষ অবশ্য অনড়। সকালে তিনি জানান, তাঁর মন ভেঙে গিয়েছে। ‘‘পড়ুয়ারা পড়ুয়াদের মতো অনশন করুক। প্রয়োজনে আমিও না-ফিরতে চেয়ে অনশনে বসবো। আমারও জীবন আছে। এই কলেজের পরিস্থিতি মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না,’’ বলেন তিনি। কোন পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করল পদত্যাগ করতে?
অমিতবাবু শনিবার বলেছিলেন, ছাত্রদের জন্য কাজ করতে চেয়েও কলেজের কিছু বুদ্ধিজীবীর জন্য তিনি তা করতে পারছেন না। কারা সেই বুদ্ধিজীবী, সোমবারেও তা স্পষ্ট করেননি অমিতবাবু। বলেছেন, ‘‘রহস্যটা রহস্যই থাকুক।’’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও কাজ চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন অমিতবাবুকে। সাড়া দেননি অধ্যক্ষ। আজ, মঙ্গলবার কলেজ কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। কাউন্সিলের সম্পাদিকা মধুমঞ্জরী মণ্ডল বলেন, ‘‘কেন ওঁর এই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, তা স্পষ্ট নয় আমাদের কাছেও। তবে আমরা সকলেই চাই, উনি ফিরে আসুন। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতেই বৈঠক ডাকা হয়েছে।’’
বিশপ অশোক বিশ্বাস জানান, অমিতবাবু তাঁর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন ঠিকই। তবে বিশপ হিসেবে তিনি তার কোনও উত্তর এখনও দেননি। ‘‘কোনও মানসিক অসুবিধা হচ্ছে হয়তো। ওঁর সঙ্গে ইতিমধ্যে এই নিয়ে কথাও হয়েছে আমার। তবে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তা নেবে কলেজ কাউন্সিলই,’’ বলেন অশোকবাবু।
স্কটিশ চার্চে দিনভর নাটকের মধ্যেই স্বাভাবিক হচ্ছে জয়পুরিয়া কলেজ। সেখানকার জট কেটে গিয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা নন্দিতা চক্রবর্তী। আজ, মঙ্গলবার সেখানে ফের ক্লাস শুরু হচ্ছে। সোমবার কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেন নন্দিতাদেবী। সেখান থেকেই ফোনে কথা হয় পরিচালন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয়, মঙ্গলবার ফের ক্লাস চালু হবে। তবে অধ্যক্ষার হুঁশিয়ারি, ‘‘কলেজে ফের কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।’’ কী ধরনের কড়া সিদ্ধান্ত, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি। অধ্যক্ষা যে-পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন, সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে পরিচালন সমিতির বুধবারের বৈঠকে।
এ দিন পরিচালন সমিতির সঙ্গে অধ্যক্ষার যে-বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। কেন?
অধ্যক্ষার কথায়, ‘‘সদস্যেরা সময় করে উঠতে পারেননি। তাই ফোনেই কথা হয়েছে। বুধবার পরিচালন সমিতির সঙ্গে আলোচনা হবে।’’ শিক্ষকদের সঙ্গে এ দিনের বৈঠকে কী কী ঠিক হয়েছে? কলেজ সূত্রের খবর, বৈঠকে ঠিক হয়েছে, আপাতত কলেজে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন থাকবে। প্রধান দরজার বাইরেও থাকবে পুলিশের নজরদারি। পরিচয়পত্র দেখে তবেই ঢোকানো হবে পড়ুয়াদের। নন্দিতাদেবী বলেন, ‘‘পুলিশ এবং উচ্চশিক্ষা দফতরের থেকে যেমন আশ্বাস মিলেছে, তার উপরে ভরসা রেখেই ফের ক্লাস চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জয়পুরিয়া কলেজের পরিস্থিতি ও কাজকর্মকে প্রভাবিত করছেন বলে অভিযোগ। শশীদেবী অবশ্য জানান, পরিচালন সমিতির সভাপতি-পদে আছেন বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়। ওখানে ট্রাস্টি রয়েছে। ‘‘সেখানে আমি প্রভাবিত করেছি, এ সব একেবারে বোকা বোকা কথা। আমার বদনাম করার জন্য এ-সব বলা হচ্ছে। ওই যে এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন! উনি আমাকে এতই স্নেহ করেন যে, আমি এতগুলি কলেজে রয়েছি আর উনি কিছুতেই নেই, সেটা ওঁর সহ্য হচ্ছে না। উনিই সব করাচ্ছেন।’’ রাজনৈতিক শিবিরের খবর, ‘এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ বলতে নিজের দল তৃণমূলেরই এক নেতার দিকে আঙুল তুলছেন শশীদেবী।
শিক্ষামন্ত্রী জয়পুরিয়ার পরিচালন সমিতিতে সরকারি প্রতিনিধির পদ থেকে আপনাকে সরিয়ে দিলেন কেন?
শশীদেবীর জবাব, ‘‘আমিই ওই কলেজের পরিচালন সমিতিতে একমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তি। সেখানে একটা অসুবিধা তো থাকে। দলের ব্যাপার থাকে। পার্থদা বলেছেন, ‘মন্ত্রীর এখানে না-থাকা ভাল।’ আমি মেনে নিয়েছি।’’ তার পরেই তিনি জানান, জয়পুরিয়ায় যেটা মূল সমস্যা, তাঁকে বার করে দেওয়াটা তার সমাধান নয়। ‘‘গভর্নিং বডির অনেকেই এতে হতাশ। পার্থদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি বিষয়টি দেখছেন,’’ বলেন শশীদেবী।
শিক্ষিকা-নিগ্রহের পাঁচ দিনের মাথায় ত্রিমুখী তদন্ত শুরু হল কেশপুর কলেজে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা দফতর এবং তৃণমূল সমর্থক শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র প্রতিনিধিরা এ দিনই কলেজে যান। অধ্যক্ষ, পড়ুয়া ছাড়াও অভিযুক্ত ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy