মেট্রোর কাজের জন্য পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে বৌবাজারের ১৪ নম্বর সেকরাপাড়া লেনের বাড়ি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
চার বছরের বেশি কেটে গিয়েছে। গোপালের জন্য মনখারাপ ক্রমেই যেন বাড়ছে। নিঃসঙ্গ গোপালকে ফিরে পেতে মামলাও ঠুকেছেন তাঁরা। তবে, তার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
বৌবাজারে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ খনন চলাকালীন একাধিক বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল সেখানকার সেকরাপাড়া লেন ও দুর্গা পিতুরি লেনে। সেই সমস্ত বাড়ির বাসিন্দারা মেট্রোর ব্যবস্থাপনায় গত চার বছর ধরে রয়েছেন শহরের বিভিন্ন এলাকায়, ভাড়া বাড়িতে। কিন্তু তাঁদের মন এখনও পড়ে আছে বৌবাজারের সেই সব গলিতে। সেকরাপাড়া লেনের কয়েক জন বাসিন্দা জানালেন, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তাঁদের খুব মনে পড়ে অষ্টধাতুর তৈরি, প্রায় দেড় ফুটের একটি গোপালের মূর্তির কথাও।
১৩ নম্বর সেকরাপাড়া লেনের প্রাক্তন বাসিন্দা মলি চন্দ্র জানাচ্ছেন, ২০১৯ সালে সেই বিপর্যয়ের পর থেকেই তাঁরা রয়েছেন সল্টলেকে। মলি বললেন, ‘‘আমার বাড়ির পাশেই ১৪ নম্বর সেকরাপাড়া লেনের মল্লিক বাড়ি। সেখানেই রয়েছে অষ্টধাতুর ওই গোপাল। মল্লিক বাড়ির কোনও উত্তরাধিকারী না থাকায় গোপালের পুজোর দায়িত্ব পাড়ার লোকেরাই নিয়েছিলেন। নিজের সন্তানকে না খাইয়ে যেমন মায়েরা কিছু মুখে তোলেন না, তেমনই গোপালকে ভোগ না দিয়ে অনেকেই কিছু খেতেন না। গোপালের পুজো ঘিরে নানা উৎসবে মেতে উঠতাম আমরা। কিন্তু মেট্রোর বিপর্যয়ের পরে আমরা সকলে চলে এলেও ওই ভাঙা, বিপজ্জনক বাড়িতেই গোপাল রয়ে গিয়েছে। এখন আর ওই বাড়িতে কেউ ঢুকতেও পারে না। গোপাল না খেয়ে আছে বছরের পর বছর।’’
সেকরাপাড়া লেনের বাসিন্দা জয়ন্ত দত্ত থাকেন ওই ১৪ নম্বর বাড়ির কাছেই। মেট্রোর কাজের জন্য ভাঙাচোরা অবস্থায় থাকা ওই রাস্তা দিয়েই মাঝেমধ্যে ঘুরে যান ১৪ নম্বর বাড়ির কাছ থেকে। সম্প্রতি ওই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘‘গোপালকে তো দেখতে পাই না, তাই গোপাল যে বাড়িতে রয়েছে, সেই বাড়িটাই বাইরে থেকে দেখে যাই। যাকে আমরা রোজ দু’বেলা দেখাশোনা করতাম, তাকেই দেখতে পাচ্ছি না বছরের পর বছর।’’ জয়ন্ত জানান, মল্লিক বাড়িতে ঢুকে গোপালের পুজো করতে না পারলেও তার দর্শন পেতেন তাঁরা। কিন্তু বছর দুই আগে সেই গোপাল চুরি হয়ে যায় মল্লিক বাড়ি থেকে। পাড়ার বাসিন্দারা থানায় ডায়েরি করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ গোপাল উদ্ধার করে। তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় মল্লিক বাড়িতে। জয়ন্ত বলেন, ‘‘গোপালকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও আর যাতে সেটি চুরি না হয়, তার জন্য গোপালের ঘরের মুখে বড় পাঁচিল তুলে দিয়েছে প্রশাসন। ফলে, গোপালের দর্শন একেবারে বন্ধ।’’
মলি বললেন, ‘‘দোল থেকে শুরু করে জন্মাষ্টমী, গোপালের পুজো ঘিরে গোটা পাড়া যেন আনন্দে মেতে উঠত। পাড়ার সকলে পাত পেড়ে খেতাম। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে খুব। সল্টলেকের বাড়িতে বসে মনে হয়, কত দামি জিনিসই তো সেকরাপাড়া লেনের বাড়িতে ফেলে এসেছি। কিন্তু গোপালের মতো দামি বোধহয় আর কেউ নেই। কবে আবার গোপালের দেখা পাব, জানি না।’’
গোপালকে যাতে ওই বিপজ্জনক মল্লিক বাড়ি থেকে সরিয়ে সেকরাপাড়া লেনের অন্য কোনও কম ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করা হয়, সিটি সিভিল কোর্টে সেই আবেদন জানিয়ে মামলা করেছেন মলিরা। মলি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, যে দেবতার দেখাশোনার কেউ নেই, তার দেখাশোনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কেউ আদালতে যেতেই পারেন। আমরা গোপালের দেখাশোনা করার জন্য আদালতে গিয়েছি। মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। তবে, গোপালকে ওই বিপজ্জনক বাড়ি থেকে উদ্ধার করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’’
মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে গোপালের দেখা পাবেন না এলাকার বাসিন্দারা। এখন শুধু ওই মল্লিক বাড়ির সামনে থেকেই ঘুরে যান ওঁরা। গোপাল কেমন আছে, তা ভেবেই দিন কাটে ওঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy